মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫

একজনকে অস্ত্র দিয়ে ফাঁসাতে গিয়ে উল্টো মামলা খেলেন ৬ জন

আনোয়ারা প্রতিনিধি

আনোয়ারা উপজেলায় বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষ, পুলিশের উপর হামলা ও অস্ত্র উদ্বারের ঘটনায় চারটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

গতকাল সোমবার রাতে পুলিশ বাদী হয়ে দুটি ও উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আব্দুল গফুর ও মোস্তাফিজুর রহমান বাদী হয়ে অপর দুটি মামলা দায়ের করেন।

সবমিলিয়ে চার মামলায় ৬২ জনের নামোল্লেখ ও অজ্ঞাতনামা আরো ১৪০ জনকে আসামী করা হয়েছে। গতকাল রাতে আনোয়ারা থানা পুলিশ ও চট্টগ্রাম থেকে রিজার্ভ পুলিশ নিয়ে আসামীদের ধরতে সাঁড়াশি অভিযান চালায় পুলিশ।

অভিযানে বিএনপির দুইপক্ষের সাত নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন, দুধকুদড়া এলাকার নুরুল আবছার (৫৫), উত্তর বন্দর এলাকার আবুল কালাম আজাদ (৫৩), ডুমুরিয়া গ্রামের মো. আরাফাত (২৬), পীরখাইন এলাকার শফিউল আলম (২৬), ভিংরোল এলাকার মো. এরফান (৩১), দুধকুমড়া এলাকার মো. কাশেম (৪৫), তেকোটা এলাকার মোস্তাক আহমদ (৫৫)। গ্রেপ্তারকৃতদের গতকাল আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে।

এছাড়া সংঘর্ষের সময় বিএনপি নেতা আব্দুল গফুর সওদাগরের মেয়ের জামাইকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে হাতে একটি দেশীয় তৈরি বন্দুক ধরিয়ে দিয়ে ছবি এবং ভিডিও বানিয়ে পরে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার ঘটনায় ভুক্তভোগী মোস্তাফিজুর রহমান সুজন বাদী হয়ে ৬ জনকে আসমী করে একটি মামলা দায়ের করেন।

অভিযুক্তরা হলেন মোফাজ্জাল হোসেন জুয়েল,বোরহান উদ্দিন,গাজী মো. ফোরকান, জিয়াউল কাদের জিয়া, রবিউল ইসলাম নয়ন, মো. আরাফাত।

মামলার এজাহারে মোস্তাফিজুর রহমান সুজন বলেন, সংঘর্ষের সময় উপরোক্ত ব্যক্তিরা আমাকে অপহরণ করে একটি অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে মারধর করে একটি এক নলা বন্দুক হাতে ধরিয়ে দিয়ে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি নেয়। পরে বোয়ালগাঁও রাস্তার মাথায় আরো কিছু নেতাকর্মীকে উপস্থিত করে পুলিশকে খবর দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।

অস্ত্র উদ্বারের ঘটনায় আনোয়ারা থানার এসআই জুয়েল বাদী হয়ে অপর একটি মামলা দায়ের করেন। এই মামলায় উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব গাজী মো. ফোরকান ও উপজেলা যুবদল নেতা জিয়াউল কাদের জিয়াকে আসামী করা হয়।

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ঘটনার দিন সকাল ছয়টায় আসামী জিয়াউল কাদের জিয়া ফোন করে বোয়ালগাঁও রাস্তার মাথা এলাকায় স্থানীয়রা একজন লোককে অস্ত্রসহ ধরে রেখেছে। পরে আমি সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্তলে গিয়ে দেখি দুইজন লোক একজন লোককে পেন্টের বেল্ট ধরে আটকে রেখেছে। পাশে একটি একনলা বন্দুক পড়ে ছিল। আমরা ঘটনাস্থলে যাওয়ার সাথে সাথে লোক দুইজন দৌড়ে পালিয়ে যায়।

এস আই জুয়েল বাদী হয়ে সংঘর্ষের সময় পুলিশের উপর হামলার ঘটনায় অপর একটি মামলা দায়ের করেন। এই মামলায় ৪২ জনকে নামোল্লেখ ও অজ্ঞাতনামা আরো ১২০ জনকে আসামী করে মামলাটি দায়ের করা হয়।

মামলার এজাহারে উল্লেখ করেন, ঘটনার দিন তিনি থানায় ডিউটি অফিসারের দায়িত্ব পালন কালে রাত দেড়টায় উপজেরা হাসপাতাল মোড়ের প্রধান সড়কে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব লায়ন হেলাল উদ্দিনের অনুসারী এবং বারশত ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির নাবেক যুগ্ন আহবায়ক মো. হাসানের অনুসারীদের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষের ঘটনা চলছে। পরে থানার ওসিসহ আমরা সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ তামাতে সচেষ্ট হলে সংঘর্ষে লিপ্ত নেতাকর্মীরা পুলিশকে উদ্দেশ্য করে ইটপাটকেল ও কাঁচের বোতল নিক্ষেপ করে।

এতে পুলিশের কনস্টেবল বিশাল চক্রবর্তী,কামাল হোসেন,ও আবু তালেব খান আহত হয়। পরে পুলিশ ফাঁকা গুলি ছোড়ে সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রনে আনে।

অপর আরো একটি মামলা দায়ের করেন উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আব্দুল গফুর সওদাগর। এই মামলায় ১২ জনকে নামোল্লেখ ও আরো ১০ থেকে ১২ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামী করে মামলাটি দায়ের করেন।

মামলার এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, পারকী সৈকতের পাশে বেড়িবাঁধের ব্লক বসানোর জন্য ৪৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। সেখানে মূল ঠিকাদারকে আমিসহ বারশত ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মো. হাসান মূল ঠিকাদারকে মালামাল রাখার জায়গা ও ইট, বালু, পাথর সরবরাহের কাজ পেলে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব লায়ন হেলাল উদ্দিন গ্রæপের নেতাকর্মীরা ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেন ।

ঘটনার দিন রাত আটটার দিকে আমরা বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে আসার সময় উপজেলা স্বেচ্চাসেবকদলের সদস্য সচিব গাজী ফোরকানের নেতৃত্বে ২০-২৫ জনের একটি দল আমাদের সিইউএফএল এলাকায় রাস্তা আটকে আমাদের মারধর ও গাড়ী ভাঙ্গচুর চালায়। এসময় তারা আমাদের কাছ থেকে বেড়িবাঁধে কাজ করতে গেলে ৫ লাখ টাকা চাাঁদা দিতে হবে বলে হুমকি দেয়।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব লায়ন হেলাল উদ্দিন বলেন, ঘটনাটা পারকী সৈকত এলাকার বেড়িবাঁধ সংলগ্ন একটি জমি কেন্দ্রিক । এই জমিটির মালিক স্থানীয় বিএনপি নেতা মো. ছাদেক। জামেম রহমান নামের এক লোক তার জমিটি জোরপূর্বক দখল করে। এজন্য তিনি থানায় অভিযোগ দেন। জায়েম রহমান কানাডা পালিয়ে যাওযায় তার ভাই পরিচয়ে আওয়ামী দোসর কবির নামের এক ব্যক্তিও জায়েম রহমানের পক্ষে থানায় অভিযোগ দেয়। পরে তাকে চ্যালেঞ্জ করলে সে আবার জায়েম রহমানের প্রতিনিধি দাবী করেন।

পরে সোস্যাল মিডিয়ায় আওয়ামঢী ফ্যাসিট্ট মন্ত্রী-এমপিদের সাথে তার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে সে থানা থেকে সকলের অগোচরে পালিয়ে যায়। পরে রাতে জমির মালিক ছাদেককে হাসান চেয়ারম্যানের লোকজন মারধর করলে আমার লোকজন তা প্রতিহত করে। বিষয়টা সেখানেই মিটমাট হয়ে যায়।

পরে তারা সংঘবদ্ধ হয়ে ২০-২৫ টা মোটর সাইকেল, কার, হাইয়েস ও মিনি ট্রাক নিয়ে প্রথমে সিইউএফএল এলাকায়, এরপর কাফকো এলাকায়, পরে রা ১২ টায় মিছিল সহকারে শোডাউন দিয়ে থানায় অভিযোগ দিতে যায়। এসময় তারা লাইভে আমার বিরুদ্ধে অশ্রাভ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। এগুলো সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে আমার পক্ষের লোকজন থানা তেকে ফেরার পথে প্রতিরোধ করলে সংঘর্ষ হয়।

এসময় আমার নেতাকর্মীরা সুজন নামে একজন ছাত্রলীগের ক্যাডারকে অস্ত্রসহ আটক করে। তার বিরুদ্ধে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলার ঘটনায় মামলা রয়েছে। শুনেছি তাকে পুলিশ ছেড়ে দিয়ে উল্টো যারা ধরেছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। এটি একটি আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের যোগসাজসে একটি পরিকল্পিত মামরা। এই ব্যাপারে আমরা পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করব। মামলাগুলো আমরা আইনি প্রক্রিওয়ায় মোকাবেলা করব।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাবেক বারশত ইউপির চেয়ারম্যান মো. হাসান একটু পরে কথা বলবে বলে লাইন কেটে দেন।

আনোয়ারা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. মনির হোসেন বলেন, হাসান চেয়ারম্যান, আবদুল গফুর সওদাগর মিছিল সহকারে এসে থানায় একটি রিখিত অভিযোগ দেয়। আমি তাদেরকে বলেছি এটা থাক পরে দেখব। এসময় আমার কাছে খবর আসে তারা থানায় আসার খবরে রায়ন হেলাল উদ্দিনের অনুসারীরা বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে অবস্থান নেয়। পরে আমি তাদেরকে থানায় রেখে বাহির হয়ে লায়ন হেলালের অনুসারী নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলি। তারা আমাকে আশ্যস্থ করেছে যে তারা কোনো সংঘর্ষ করবেনা। পরে তাদেরেকে চলে যেতে বলি। আমি পোর্স নিয়ে তাদের সামনে ছিলাম। তারা চলে যাওয়ার সময় হাসপাতাল মোড়ে ফৌঁছলে চারিদিক থেকে লায়ন হেলালের অনুসারীরা ঘিরে ফেলে। এসময় পুলিশসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়। পুলিশ সংঘর্ষ থামাতে ফাঁকা গুলি ছোড়ে। ফাঁকা গুলি ছোড়ায় তারা ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশকে এরাপাতাড়ি ইটপাটকেল, কাঁচের বোতল নিক্ষেপ করে।

এতে পুলিশের বেশ কয়েকজন সদস্য আহত হয়। পরে সকালে একপক্ষ সুজন নামের একজনকে একটি দেশীয় অস্ত্রসহ পুলিশকে ফোন করে তুলে দেয়। তদন্তে জানতে পারলাম অস্ত্রটি তাকে ফাঁসানোর জন্য জোরপূর্বক হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। আমরা ঘটনার সবকিছু তদন্ত করে মামলাগুলো গ্রহণ করেছি। রাতে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে উভয় পক্ষের ৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছি। অভিযান অব্যাহত রয়েছে। মামলার বাকী আসামীদেরও গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

আনোয়ারা সহকারি পুলিশ সুপার সোহানুর রহমান সোহাগ জানান, ঐদিন পুলিশ তাৎক্ষনিক ফাঁকা গুলি ছোড়াসহ সংঘর্ষ থামাতে পদক্ষেপ না নিলে আরো বড় ধরণের হতাহতের ঘটনা ঘটতে পারত। এজন্য এলাকায় শান্তি শৃঙ্কলা বিনষ্ট করতে চাইলে সে যেই হোক ছাড় দেওয়া হবেনা। সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।

চাটগাঁর চোখ/ এম এ

সর্বশেষ

এই বিভাগের আরও খবর