গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নিয়ে সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার ডাকে সাড়া দিয়ে আজ বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) বিকেলে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বৈঠকে বসেছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। বৈঠক শেষে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ৫ মাস পর ঘোষণাপত্রের প্রয়োজন আছে কি না তা আমরা জানতে চেয়েছি। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল গোলাম পারোয়ার বলেছেন, এমন একটা দলিল তৈরিতে অস্থিরতা দরকার নেই, সবার সঙ্গে আলোচনা দরকার।
এদিকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রণয়নে কোনো তাড়াহুড়ো ও অস্থিরতা সৃষ্টি না করে আরো আলোচনা ও যাচাই-বাছাই করার প্রতি জোর দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো, এমনটাই দাবি করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। প্রধান উপদেষ্টার সাথে বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের একথা জানান।
বৈঠকে বিএনপি-জামায়াত ছাড়াও হেফাজতে ইসলাম, বামমঞ্চ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটিসহ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সব রাজনৈতিক শক্তি অংশগ্রহণ করেছে।
তিনি বলেন, বৈঠকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রণয়ের বিষয়ে সবাই একমত হয়েছে। সবাই বলেছেন- এ ধরনের একটা ঘোষণাপত্র করার দরকার আছে। তবে এখানে অনেক সাজেশন আসছে; মোটাদাগে হলো- ঘোষণাপত্রে সবার অবদান আছে বলতে হবে, ধারাবাহিকতা উল্লেখ করতে হবে।
আসিফ নজরুল বলেন, ঘোষণাপত্রের রাজনৈতিক নেচার বা লিগ্যাল নেচার কী হবে সেটা স্পষ্ট করতে হবে। বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এই ঘোষণাপত্র আরও বেশি আলোচনার ভিত্তিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে রাজনৈতিক শক্তি, ছাত্র জনতা- সবার মধ্যে আলোচনা করে সর্বসম্মতিক্রমে এটাকে প্রণয়ন করতে হবে। এটার জন্য যত সময় প্রয়োজন সময় নেওয়া যেতে পারে। তবে এটাও বলছে যাতে অযথা কালবিলম্ব না হয়। সবাই ঐকমত্য হয়েছে, আরও নিবিড় পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে এই ধরনের ঘোষণাপত্র হওয়া উচিত। সবাই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন এই প্রক্রিয়ায় আমরা সফল হতে সক্ষম হবো।
এর আগে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে সর্বদলীয় বৈঠকে বসেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ওই বৈঠক শুরু হয়ে সন্ধ্যা ৬টার কিছু আগে শেষ হয়। পরে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন বৈঠক অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দ।
ঘোষণাপত্রের প্রয়োজনীয়তা জানতে চায় বিএনপি: বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, সকল রাজনৈতিক দল যারা ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে জড়িত ছিল এবং আমাদের সাথে ছিল, তাদের সবাইকে নিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক যে কোনো বক্তব্য আমরা দিতে চাই। যে কোনো রকমের অনৈক্যের বীজ যেন আমাদের মধ্যে বপণ করতে না পারে কোনো ফ্যাসিবাদী শক্তি ও ফ্যাসিবাদের দোসররা, সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। আমাদেরকে আজ প্রধান উপদেষ্টা আহ্বান করেছিলেন। আমরা এসেছি। আমাদের পরামর্শ যা দেওয়া দরকার রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য এবং বিভিন্ন বিষয়ে, যে সব মতামত আমাদের দেওয়া প্রয়োজন আমরা দিয়েছি।’
বিএনপির এই কেন্দ্রীয় নেতা আরও বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান বিষয়ে কিছু নিয়ে কিছু আলোচনা হয়েছে সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে। বিভিন্ন পরামর্শমূলক বক্তব্য প্রদান করা হয়েছে। আমরা প্রশ্ন করেছি যে, সাড়ে ৫ মাস পরে জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের কোনো প্রয়োজন ছিল কি না। যদি থেকে থাকে, সেটার রাজনৈতিক গুরুত্ব, ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং আইনি গুরুত্ব কী সেগুলো নির্ধারণ করতে হবে। এই ঘোষণাপত্রকে কেন্দ্র করে ফ্যাসিবাদ বিরোধী যে ঐক্য সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে যাতে ফাটল সৃষ্টি না হয় সেদিকেও আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে।’
সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এটা যেন রাজনৈতিক দলিল, ঐতিহাসিক দলিলে পরিণত হয়, সেই দলিলটাকে অবশ্যই আমরা সম্মান করি। কিন্তু সেটা প্রণয়ন করতে গিয়ে যাতে সংশ্লিষ্ট সকলকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, পরামর্শ নেওয়া হয় সেদিকটা আমরা পরামর্শ দিয়েছি। সে বিষয়ে আমি প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সকল উপদেষ্টাকে অনুরোধ করেছি। এ দিকে যেন তারা নজর রাখেন এবং সে হিসেবে পদক্ষেপ নেন। যাতে জাতীয় ঐক্যে যেনো কোনো রকম ফাটল তৈরি না হয়। আমাদের মধ্যে যাতে কোনো বিভ্রান্তি তৈরি না হয়। এগুলো আলাপ হয়েছে।’
নির্বাচন নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা ঘোষণাপত্র নিয়ে আমাদের নানা পরামর্শ দিয়েছি। বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিক দলিল প্রণয়নের বিষয়ে আমরা কথা বলেছি।’
অস্থিরতা চায় না জামায়াত: বৈঠক শেষে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল সাংবাদিকদের বলেন, ‘এমন একটা দলিল তৈরিতে অস্থিরতা দরকার নেই, সবার সঙ্গে আলোচনা দরকার। অনেক কিছু বাদ পড়েছে, কোন মৌলিক ইস্যু যেন বাদ না পড়ে যায় তা নিয়ে কথা বলেছি আমরা। আজকের আলোচনা প্রাথমিক। খসড়ার ভুল-ত্রুটি তুলে ধরা হয়েছে। আবারও বৈঠক হবে।’
গোলাম পারোয়ার বলেন, ‘অনেক মৌলিক জিনিস এই কাঠামো থেকে বাদ পড়েছে। বাংলাদেশের ইসলামি শক্তি একটি বিশাল শক্তি। এই ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে তাদের যে অসাধারণ ত্যাগ, বহু মানুষকে শহিদ করা হয়েছে। নিরীহ নিরপরাধ নেতাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে, গুম-খুন, ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে। এই সত্য ইতিহাসগুলো ঘোষণাপত্রের কাঠামোতে স্থান পায়নি।’
জামায়াতের অন্যতম শীর্ষ এ নেতা আরও বলেন, ‘অনেক মৌলিক জিনিস যেন এই ইতিহাস থেকে বাদ না পড়ে যায়। সে বিষয়গুলো আমরা সরকারের দৃষ্টিতে এনেছি। আমরা বলেছি, একটা প্রক্রিয়া এমন হওয়া দরকার যাতে রাজনৈতিক দল ও স্টেক হোল্ডার এখানে মত দিতে পারে। একজন উপদেষ্টা দায়িত্ব নিয়ে বলেছেন, আজকের আলোচনা একটি প্রাথমিক আলোচনা। ঘোষণাপত্রের কপি পাওয়া, মিটিংয়ে উপস্থিত হওয়া ইত্যাদি বিষয়ে অসংলগ্নতা অনেকেই তুলে ধরেছেন। একজন উপদেষ্টা এটা স্বীকারও করেছেন, এটা প্রাথমিক বৈঠক, এটাকে কনসাইজ করে আবার মত বিনিময় করা হবে।’
এনইউ/জই