শেখ হাসিনা ও তার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ‘ফ্যাসিবাদী আচরণের’ কারণে এদেশে তাদের কোনো জায়গা হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, ‘দেশের রাজনীতিতে হাসিনা ও দলের এখন কোনো জায়গা নেই।’
যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এসব মন্তব্য করেন। বুধবার পত্রিকাটির অনলাইন সংস্করণে এই সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হয়েছে।
পত্রিকাটি বলেছে, এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো ও বৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান স্পষ্ট করলেন শান্তিতে নোবেলজয়ী এই অধ্যাপক।
সাক্ষাৎকারে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, তাঁর অন্তর্বর্তী সরকার এখনই ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ চাইবে না। পত্রিকাটি বলছে, সর্ববৃহৎ প্রতিবেশী দেশের (ভারত) সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক উত্তেজনায় বাড়িয়ে দিতে পারে এমন চিন্তা থেকে হয়তো এ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা হয়েছে।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘স্বল্প মেয়াদে হলেও নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশে তাঁর (শেখ হাসিনা) কোনো জায়গা নেই—আওয়ামী লীগের কোনো জায়গা নেই।’
‘নিজেদের স্বার্থসিদ্বির জন্য বাড়িয়ে নিতে তারা জনগণকে নিয়ন্ত্রণ (দমন–পীড়ন) করেছে, তারা রাজনৈতিক দলকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, তারা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করেছে,’ বলেন ড. ইউনূস। তিনি আরও বলেন, ‘একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনো ফ্যাসিস্ট দলের অস্তিত্ব থাকা উচিত নয়।’
শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনামলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কুক্ষিগত করা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড পরিচালনা এবং সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোয় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোট জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়ার অভিযোগ করেছেন রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীরা ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর তাঁর দলকে রাজনৈতিক কার্যক্রম থেকে সাময়িকভাবে দূরে সরিয়ে রাখা, সংস্কার, নাকি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা উচিত, সে বিষয়ে বিতর্ক চলছে।
ড. ইউনূসের ধারণা, আওয়ামী লীগ একটি দুর্বল ও ব্যর্থ দলে পরিণত হতে পারে। তবে তিনি গুরুত্ব দেন যে তাঁর অন্তর্বর্তী প্রশাসন দলটির ভাগ্য নির্ধারণ করবে না। কেননা, এটি কোনো ‘রাজনৈতিক সরকার নয়’।আওয়ামী লীগ ভবিষ্যতে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না, সে বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের মধ্যকার ‘ঐকমত্যের’ ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হবে উল্লেখ করে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘তাদের রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়া নিয়ে তাদেরই (রাজনৈতিক দলগুলোকে) সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
হাসিনা ভারতের কোথায় আছেন, তা পরিষ্কার নয়। সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেছেন, তাঁর দল যেকোনো সময় নির্বাচনে অংশ নিতে প্রস্তুত।
রাজনীতিতে যোগ দেওয়া বা কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করার ইচ্ছা তাঁর নেই বলে জানিয়েছেন ড. ইউনূস। বলেছেন, নির্বাচনের সময়সূচি (এখনই) ঘোষণা করা হবে না। এ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘আমাদের কাজ বিভিন্ন বিষয়ের নিষ্পত্তি করা ও নতুন সংস্কার এজেন্ডার বাস্তবায়ন। যখন নির্বাচনের প্রস্তুতি শেষ হবে, তখন আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শ করব।’
শেখ হাসিনার পতনে তাঁর সরকারের সবচেয়ে বড় বিদেশি সমর্থক ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে টানাপোড়ন শুরু হয়েছে ।
অধ্যাপক ইউনূস বলেছেন, তাঁর সরকার শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ চাইবে। তবে তা চাওয়া হবে শুধুই দেশের অভ্যন্তরীণ অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল) রায়ের পর। ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনা ও অন্য ৪৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন।
‘তাঁর (শেখ হাসিনা) বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে…রায় পেলে ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় তাঁকে দেশে ফেরত আনার চেষ্টা করব আমরা। আমি মনে করি না যে রায় পাওয়ার আগে আমাদের এটি করার মতো কিছু আছে,’ বলেন ড. ইউনূস।
গত আগস্টে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেছিলেন, বিক্ষোভকারীদের ওপর সহিংসতা চালানোর যে অভিযোগ তাঁর মায়ের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে, তা মিথ্যা। তাঁর মা ‘কোনো বেআইনি কাজ করেননি’, তাই যেকোনো অভিযোগ মোকাবিলা করতে প্রস্তুত তিনি।
ড. ইউনূসের সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। নয়াদিল্লির অনেকে এ সরকারের প্রতি বৈরী মনোভাব দেখিয়েছেন। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে সরকার পরিবর্তন হয়েছে বলে তাঁদের অভিযোগ।
ড. ইউনূস স্বীকার করেছেন, হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কিছু সহিংসতার ঘটনা এবং তাতে খুব অল্প প্রাণহানি ঘটেছে। অবশ্য তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাঁদের সংশ্লিষ্টতা থাকায় এসব হামলা হয়েছে। ধর্মীয় পরিচিতির কারণে তাঁদের ওপর হামলা হয়নি। তিনি বলেন, ‘হিন্দু সম্প্রদায়ের অধিকাংশ মানুষ (আগস্টে হামলার প্রসঙ্গ) আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছেন। সমালোচকেরা ওই বয়ানকে (হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা) ভিন্নরূপ দিয়েছেন।’
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানকালে সহিংসতায় বিক্ষোভকারী, পুলিশ, পথচারীসহ ৮০০ জনের মতো নিহত হয়েছেন। তবে অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ব্যাপক নির্যাতন–নিপীড়ন চালানোর অভিযোগ নিশ্চিত করেনি মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
এ বিষয়ে ড. ইউনূস স্বীকার করেছেন, হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কিছু সহিংসতার ঘটনা এবং তাতে খুব অল্প প্রাণহানি ঘটেছে। অবশ্য তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাঁদের সংশ্লিষ্টতা থাকায় এসব হামলা হয়েছে। ধর্মীয় পরিচিতির কারণে তাঁদের ওপর হামলা হয়নি।
নয়াদিল্লির কাছ থেকে সমর্থনের ঘাটতি তাঁর সরকারকে ‘আহত’ করেছে বলেও মন্তব্য করেন নোবেলজয়ী ঐ অধ্যাপক। তবে বলেন, দেশে এলে মোদিকে আন্তরিক অভ্যর্থনা জানানো হবে। তিনি আরও বলেন, ‘এ ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করেছি যে আমরা প্রতিবেশী, আমাদের একে অপরের প্রয়োজন, আমাদের মধ্যে অবশ্যই সবচেয়ে ভালো বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকতে হবে, যা যেকোনো দুই প্রতিবেশীর মধ্যে থাকা উচিত।’
এনইউ/জই