এই রূপালি গীটার পেলে চলে যাবো একদিন, হাসতে দেখো গাইতে দেখো, সুখেরি পৃথিবী, সুখেরি অভিনয়, সেই তুমি কেন এতো অচেনা হলো, তারা ভরা রাতে, ফেরারী এই মনটা আমার, ঘুম ভাঙ্গা শহরে, তিন পুরুষ, আমি বার মাস তোমায় ভালবাসি, আম্মাজান আম্মাজানসহ অসংখ্য জনপ্রিয় গানের সংগীত তারকা আইয়ুব বাচ্চু চট্টগ্রামের গৌরব। কিংবদন্তী ব্যান্ড তারকা আইয়ুব বাচ্চু চিরদিনের মত আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন। গীটার হাতে আর কখনো তাকে দেখা যাবেনা, দেখা যাবেনা কোন মঞ্চে, এমনকি গাইবেনা আর কোন গান। চট্টগ্রামের আইয়ুব বাচ্চু, বাংলাদেশের আইয়ুব বাচ্চু, উপমহাদেশের আইয়ুব বাচ্চু, আমাদের আইয়ুব বাচ্চু।
১৮ অক্টোবর ২০২৪ আইয়ুব বাচ্চু’র ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী নানা আয়োজনে পালিত হবে। তিনি রেখে গেছেন রাজকন্যা নামের এক মেয়ে এবং তাজওয়ার নামে এক ছেলে। তার পিতার নাম মোহাম্মদ ইছহাক ও মাতার নাম নূর জাহান। আইয়ুব বাচ্চুর সুনাম সু-খ্যাতি দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতে পৌঁছে গেছে। তিনি চট্টগ্রামের অহংকার। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা গিয়ে আইয়ুব বাচ্চুর তারকা খ্যাতি ও আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করেছে। তার গাওয়া শতাধিক সুপার হিট গান আমাদের সঙ্গীতাঙ্গনকে করেছে সমৃদ্ধ ও বর্ণাঢ্য। চট্টগ্রাম নগরীর এনায়েত বাজার জুবিলী রোড এলাকায় জন্ম আইয়ুব বাচ্চুর, তার ডাক নাম রবিন। নগরীর মুসলিম হাই স্কুলে তিনি পড়ালেখা করেছেন। কৈশোর থেকেই সঙ্গীতপাগল ছিলেন তিনি। পাড়ায় প্রায় সকল অনুষ্ঠানেই তার উপস্থিতি ছিল। তবে প্রথমে ছিলেন শ্রোতা। বেশি আগ্রহ ছিল গিটারসহ বাদ্যযন্ত্রগুলোর প্রতি। শুরুটি হয়েছিল গিটারিস্ট হিসেবে। একটানা প্রায় এক দশক কেটে যায় গিটার হাতে। সে কারণে সঙ্গীত শিল্পীর চেয়েও তার পরিচিতি বেশি হয় গিটারবাদক রূপে। পাড়া মহল্লায় বিয়ে সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করেছেন দল নিয়ে।
১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আইয়ুব বাচ্চু। শিল্পীর সঙ্গীত জীবনের সূচনা হয় ১৯৭৭ সালে। ১৯৭৮ সালে তার প্রথম গান ‘হারানো বিকেলের গল্প’। এরপর যোগ দেন সোলসে। ১৯৮০ সাল থেকে পরবর্তী এক দশক পর্যন্ত সম্পৃক্ত ছিলেন এই ব্যান্ডে। সোলস ছাড়ার পর ১৯৯১ সালে নিজে গঠন করেন নতুন ব্যান্ড এলআরবি। প্রথমে এলআরবির পূর্ণ অর্থ ছিল লিটল রিভার ব্যান্ড। পরে এই নামে অস্ট্রেলিয়াতে আরেকটি ব্যান্ড থাকায় বদলে করা হয় লাভ রানস বাইন্ড।
তার প্রথম একক এ্যালবাম প্রকাশ পায় ১৯৮৬ সালে ‘রক্তগোলাপ নামে’। আর ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয় এলআরবির প্রথম এ্যালবাম এলআরবি। এরপর একে একে আসা এই ব্যান্ডের অন্য এ্যালবামগুলো সুখ (১৯৯৩), তবুও (১৯৯৪), ঘুমন্ত শহরে (১৯৯৫), ফেরারী মন (১৯৯৬), স্বপ্ন (১৯৯৬), আমাদের বিষ্ময় (১৯৯৮), মন চাইলে মন পাবে (২০০০), অচেনা জীবন (২০০০), অচেনা জীবন (২০০৩), মনে আছে নাকি নেই (২০০৫), স্পর্শ (২০০৮), যুদ্ধ (২০১২) প্রকাশ পায়। একক এ্যালবামের মধ্যে রক্তগোলাপের পর রয়েছে ময়না (১৯৮৮), কষ্ট (১৯৯৫), সময় (১৯৯৯৮), একা (১৯৯৯), প্রেম তুমি কি! (২০০২), দুটি মন (২০০২), কাফেলা (২০০২), প্রেম প্রেমের মতো (২০০৩), পথের গান (২০০৪), ভাটির টানে মাটির টানে (২০০৬), জীবন (২০০৬), সাউন্ড অব সাইলেন্স (ইন্টস্ট্রুমেন্টাল ২০০৭), রিমঝিম বৃষ্টি (২০০৮), বলিনি কখনো (২০০৯), জীবনের গল্প (২০১৫)। এ ছাড়াও প্রচুর মিশ্র এ্যালবামে কাজ করেছেন।
১৯৭৩ সালে সুরেলা ব্যান্ডের জন্ম হয়। এরপর ১৯৭৪ সালে জন্ম নেয় সোলস। শুরুতেই ঐ বছরেই যোগ দেয় তপন চৌধুরী এবং ১৯৭৫ সালে যোগ দেন নকীব খান। সর্বশেষ ১৯৮২ সালে সোলস ব্যান্ড আইয়ুব বাচ্চুর পদার্পন ঘটে। সোলস ব্যান্ড থেকে চারটি এ্যালবামে আইয়ুব বাচ্চু সাথে ছিলেন। লীড গীটারিস্ট হিসেবে যোগ দিলেও পরে বাংলা ও ইংরেজী গান করতেন। সোলস এর স্বর্ণযুগ সময়ে আইয়ুব বাচ্চু সাথে ছিলেন। তবে দুঃখের বিষয়, এত জনপ্রিয় গান করার পরে তাকে জাতীয় পুরস্কার দেওয়া হয়নি। দাবি জানাচ্ছি, মরণোত্তর হলেও জাতীয় পুরস্কার দেওয়ার। মুঠোর ভিতর পদ্ম নিয়ে, ঘুম ভাঙ্গা শহরে কলেজের করিডোরে ফেরারী মনটা আমার, চাঁদ এসো কি, দেখ দেখি জনতা, তুমি আমি নয় আজ চল গাই গান, সোলস্ এর এই গানগুলো আইয়ুব বাচ্চু সুর করেছেন।
আইয়ুব বাচ্চুর গান, স্টেইজ শো, টেলিভিশনে পারফরম্যান্স, সব ক্ষেত্রেই আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। গীটার বাজানো দিয়ে তার গান শুরু দর্শকরা অন্যভাবে উপভোগ করতো। তরুণ প্রজন্মের কাছে আইয়ুব বাচ্চু ছিল প্রাণপুরুষ। স্টেইজে উঠা মাত্রই আইয়ুব বাচ্চুকে দেখে দর্শকদের যে আনন্দ-অনুভূতি, সেটি খুব কম শিল্পীর বেলায় ঘটে। কোন স্টেজে কোন পরিবেশে শ্রোতাদের মন বুঝে কি গান গাইতে হবে সেটি আইয়ুব বাচ্চু সবচেয়ে ভাল বুঝতেন। শ্রোতাদের বুক ভরা ভালোবাসা তাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে।
আইয়ুব বাচ্চু’র ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা রইল। তাঁর গাওয়া গানগুলো কোটি মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকুক চিরকাল চিরদিন।
লেখক: সাংবাদিক ও গীতিকার
এনইউ/জই