মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫

রাস্তায় পড়ে আছে পারভেজের সাইকেল আর নিথর দেহ

*রাস্তায় পড়ে আছে পারভেজের সাইকেল আর নিথর দেহ ; বঙ্গবন্ধু টানেল এলাকায় ফের দুর্ঘটনা

তিন সন্তান নিয়ে পরিবারের রুটিরুজির পথ সুগম রাখার নিমিত্তে দীর্ঘ ৫ বছরের বেশি সময় ধরে ১২ কিলোমিটার এর বেশি পথ সাইকেল চালিয়ে কর্ণফুলী স্যু ফ্যাক্টরি (কেএসআই) তে নিরাপত্তা কর্মীর চাকরি করত আনোয়ারা উপজেলার পরৈকোড়া ইউনিয়নের মাহাতা গ্রামের আনোয়ার পারভেজ। তাঁর সেই সংগ্রামের মর্মন্তুদ সমাপ্তি ঘটাল ঘাতক ট্রাক ড্রাইভারের খেয়ালীতে।

প্রত্যক্ষদর্শী ও নিহতের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলবার ভোর ৬:৪০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু টানেল সড়কে আনোয়ারা প্রান্ত দিয়ে আনোয়ার পারভেজ ও একই কোম্পানিতে কর্মরত দুইজন নিরাপত্তা কর্মী সহ সাইকেল চালিয়ে কর্মস্থলে যাচ্ছিল। কিছুদূর যাওয়ার পর পেছন থেকে দ্রুতগামী একটি ট্রাক চাপা দিয়ে চলে যায়। মুহুর্তেই রক্তে ভেসে যায় টানেল সড়ক। পারভেজ এর একটি পা ভেঙ্গে যায়। প্রচুর রক্তক্ষরণ এর কারনে ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান আনোয়ার পারভেজ।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আরেক নিরাপত্তাকর্মী নাজিম উদ্দীন জানান, আমরা প্রতিদিন এক সঙ্গে আগে-পিছে করে সাইকেল চালিয়ে কর্মস্থলে যাই। আজও সাইকেল চালিয়ে টানেলের সংযোগ সড়কের এক কিলোমিটার যেতে না যেতে একটি ট্রাক পারভেজ এর পেছন দিক দিয়ে ধাক্কা মেরে পায়ের উপর দিয়ে চাপা চলে যায়। একটা মানুষ চোখের সামনেই নেই হয়ে গেল মানতেই পারছিনা।

নিহত আনোয়ার পারভেজ (৪২) কোরীয় রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলে (কেইপিজেড) কর্ণফুলী শুজ ইন্ডাস্ট্রি (কেএসআই) নামে একটি কারখানায় নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি আনোয়ারা উপজেলার পরৈকোড়া ইউনিয়নের মাহাতা গ্রামের ছৈয়দ আহমেদের ছেলে। সে পাঁচ ভাই বোনের বোনের মধ্যে ২য়।

এদিকে নিহত আনোয়ার পারভেজ এর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। নিহত পারভেজ এর মা, তিন অবুঝ সন্তানের বিলাপে আকাশ-পাতাল ভারি হয়ে উঠছে। নিহতের ভাই হাফেজ মাসুদুল করিম কান্না চেপে এই প্রতিবেদককে তথ্য দিচ্ছিলেন।
পাশে ঢুকরে ঢুকরে কাঁদছিলেন মা ও দুই বোন। দুই পুত্র ও এক কন্যা সন্তান এর চোখে মুখে বাবা ফেরার অপেক্ষা। যেন প্রতিদিনের মত ডিউটি সেরে ফিরবেন আর ডাক দিবেন ও সায়েম, সিয়াম ও সায়েমা দরজা খোল, আমি আসছি। পারভেজ এর বড় সন্তান মো সায়েম (১২) , মাহাতা তাজবিদুল কুরান মাদ্রাসা থেকে কুরান হিফজ শেষ করেছেন ২য় সন্তান ফাহমিদা সুলতানা সায়মা (১০) মাহাতা পাঠনিকোটা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী, মো. সিয়াম (৪) স্থানীয় কিন্ডারগার্টেনে নার্সারিতে পড়ে।

পারভেজ এর বড় বোন, বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘আমার ভাই অনেক কষ্ট করে সংসার চালাত। ফজর নামাজ পড়ে বের হয়ে যেত, ঘরে ফিরত মাগরিবের পর। আমার ছোট ছোট ভাইপুত, ভাইজি কে কার হাতে দিয়ে গেল ভাই।

কেএসআই’র নিরাপত্তা ব্যবস্থাপক, সাঈদুল হক জানান, পারভেজ একজন কোম্পানির নিবেদিত প্রাণ কর্মী। সময়মত কর্মস্থলে উপস্থিত থাকত। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত বেদনার এবং অপূরনীয় ক্ষতি। আমরা নিহতের মেডিকেল ও অন্যান্য কাগজপত্র সংগ্রহ করে ম্যানেজমেন্টকে দিয়েছি। ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির রুল অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহন করবে।

আনোয়ারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সোহেল আহমেদ জানান, লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে। ঘাতক ট্রাক জব্দের চেষ্টা ও প্রয়োজনীয় আইনি প্রক্রিয়া চলমান।

উল্লেখ্য গত ২৮ অক্টোবর, ২০২৩ তারিখে বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধন এর পর থেকে গত গত তিন মাসে টানেলের ভেতরে-বাইরে ছয়টি দুর্ঘটনা ঘটল। এতে দুজন নিহত হয়েছেন। ১৮ জানুয়ারি সকালে টানেলের ভেতর চাকা ফেটে মুরগিবাহী পিকআপ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা দেয় টানেলের টিউবে। এতে ডেকোরেশন বোর্ড ভেঙে যায় এবং অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৬ জানুয়ারি সকালে টানেল সড়কের বৈরাগ এলাকায় দ্রুতগতির মাইক্রোবাসের ধাক্কায় সিকিউরিটি পোস্ট ভেঙে দায়িত্বরত একজন নৌবাহিনীর সদস্যসহ সাতজন আহত হন। গত বছরের ১০ নভেম্বর টানেলের পতেঙ্গা প্রান্তে ওয়াই জনশনসংলগ্ন এলাকায় বাসের ধাক্কায় একজন নিহত হন। ৩ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের ভেতরে একটি প্রাইভেট কারকে পেছন থেকে একটি বাস ধাক্কা দিলে প্রাইভেট কারটি দুমড়েমুচড়ে যায় এবং চারজন আহত হন। ৩০ অক্টোবর আনোয়ারা প্রান্তে টোল প্লাজা–সংলগ্ন এলাকায় একটি প্রাডো গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রেলিংয়ের সঙ্গে ধাক্কা লেগে দুর্ঘটনা ঘটে।

সর্বশেষ

এই বিভাগের আরও খবর