চিকিৎসাজনিত কারণে অবস্থান করছি ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের ব্রহ্মসান্দ্র শহরে। এখান থেকে মাত্র সোয়া একশ কিলোমিটার দূরেই ইতিহাসে মোড়া রাজ্য মহীশূর। শৈশবে পাঠ্যপুস্তকে কিংবা টিভি সিরিয়ালে টিপু সুলতানের নাম শুনেছি বহুবার—তাঁর জন্মভূমির এত কাছে এসে একবার চোখে না দেখে ফেরা যায়? না, তা তো হতে পারে না!

পরিকল্পনা করলাম, পুরো মহীশূর ঘুরে দেখব, যতটা সম্ভব একদিনে। স্থানীয় এক পরিচিতজনের মাধ্যমে দেখা হলো মোহাম্মদ তামিম নামের আসাম-নিবাসী এক যুবকের সঙ্গে। তাঁর পেশা পর্যটকদের জন্য গাইড ও চালক হিসেবে কাজ করা।

একটি ব্রিটিশ মোটরসাইকেল যা ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত উৎপাদিত হয়। ১৯২ সিসির পানি-শীতলিত টুইন-সিলিন্ডার ইঞ্জিন, শ্যাফ্ট ড্রাইভ ও প্রেসড স্টিল ফ্রেমসহ এটি একটি অভিনব ডিজাইনের বাহন। ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনীতে ব্যবহারের কারণে একে বলা হতো “Noddy Bike”। ছবিটি তোলা হয়েছে পায়ানা কার মিউজিয়ামে।
তামিম যখন সম্ভাব্য গন্তব্যগুলোর তালিকা বলছিলেন—টিপু সুলতানের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ, তাঁর সমাধি, রাজপ্রাসাদ—তখনো বুঝিনি, এ যাত্রার সবচেয়ে বড় চমকটা অন্য কোথাও লুকিয়ে আছে। রোববার (১১ মে), সকাল ছয়টা। সূর্য তখনো পুরোপুরি ওঠেনি। তামিম গাড়ি নিয়ে নিচে এসে দাঁড়ালেন, আর শুরু হলো আমাদের যাত্রা। বেঙ্গালুরু-মহীশূর এক্সপ্রেসওয়ের মসৃণ পথ ধরে প্রায় আড়াই ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম আমাদের গন্তব্যে।
টিপুর প্রাসাদ ও সমাধি ঘুরে যখন ফিরছি, হঠাৎ তামিম প্রস্তাব দিল, “স্যার, এখানে একটা গাড়ির জাদুঘর আছে, যাবেন?” চমকে উঠলাম—গাড়ির জাদুঘর? সত্যিই এমন কিছু সম্ভব? আমি কিছু বলার আগেই সে গাড়ির দিক ঘুরিয়ে জানালার কাচ নামিয়ে বলল, “এই যে দেখুন, ওটাই পায়ানা মিউজিয়াম।”

দূর থেকে চোখে পড়ল বিশাল এক টায়ার-আকৃতির ভবন। যেন কোনো সময়-যন্ত্রের ভেতরে টেনে নিচ্ছে আমাদের। ‘পায়ানা’—কন্নড় ভাষায় যার অর্থ ‘ভ্রমণ’। নামের সঙ্গে মিলে যাওয়া এক পূর্ণাঙ্গ অভিজ্ঞতার শুরু। প্রবেশমুখে হাস্যোজ্জ্বল এক নারী আমাদের স্বাগত জানালেন। ৭৫ রুপিতে দুটো টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম এক বিস্ময়পুরীতে। ২৩ একর জায়গাজুড়ে গড়ে ওঠা এই পায়ানা ভিন্টেজ কার মিউজিয়ামটি প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করছেন ধর্মস্থলার ধর্মাধ্যক্ষ ও গাড়িপ্রেমিক ডি ভীরেন্দ্র হেগগাড়ে।

প্রবেশ করেই যেন পড়লাম এক অনন্য জগতে। দুই তলায় সাজানো আছে ৮০টিরও বেশি দুর্লভ ও সংরক্ষিত গাড়ি, প্রতিটিই একেকটি সময়ের প্রতিচ্ছবি।
প্রথমেই চোখে পড়ল ১৯৬২ সালের চকচকে স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড। এরপর একে একে দেখতে পেলাম ১৯৪৬ সালের ফোর্ড প্রিফেক্ট, ১৯৪৭ সালের সিট্রোয়েন ট্র্যাকশন অ্যাভ্যান্ট, এবং চোখ জুড়িয়ে যাওয়া ১৯৫৫ সালের শেভরোলেট বেলএয়ার। ভারতীয় ইতিহাসের সাক্ষী হিন্দুস্তান ল্যান্ডমাস্টার ও অ্যাম্বাসাডরও বাদ যায়নি।

দর্শনীয় ডিজাইনের এই ভিনটেজ গাড়িটি ১৯৪৮ সালের Buick Roadmaster বা Super Eight মডেল। এর স্ট্রিমলাইন স্টাইলিং, ওয়াটারফল গ্রিল ও প্রশস্ত কাচের কাঠামো একে আলাদা করে তোলে। ১৯৪৬-১৯৫৭ সালের মধ্যে এটি ছিল Buick-এর ফ্ল্যাগশিপ মডেল, যেখানে শক্তিশালী ইনলাইন ৮-সিলিন্ডার ইঞ্জিন ও আরামদায়ক অভ্যন্তর ছিল বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
তবে শুধু ক্ল্যাসিক গাড়ি নয়—এখানে রয়েছে ঐতিহাসিক মূল্যবোধসম্পন্ন যানও। যেমন পদ্মবিভূষণপ্রাপ্ত স্যার সি ভি রমনের ব্যবহৃত স্টুডিবেকার চ্যাম্পিয়ন, আবার ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধীর ব্যবহৃত ডজ কিংসওয়ে কনভার্টিবলও। রোলস রয়েস গ্যালারিতে একশ বছরেরও বেশি সময়জুড়ে তৈরি হওয়া গাড়ির সংগ্রহ দেখে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। পাশে রয়েছে মুম্বাইয়ের আইকনিক লাল ডাবল ডেকার বাসের প্রতিরূপ—যেন শহরের ছন্দধ্বনির প্রতিচ্ছবি।

এই জাদুঘরের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ এর ‘ইন্টারঅ্যাকটিভিটি’। শুধু দর্শন নয়—জানার সুযোগও রয়েছে এখানে। প্রতিটি গাড়ির সামনে রয়েছে বিস্তারিত বিবরণ, কিছু কিছু জায়গায় রয়েছে টাচস্ক্রিন কিয়স্ক। সেখানে আপনি জানতে পারবেন গাড়ির প্রযুক্তি ও নকশার বিবর্তনের গল্প। ভেতরে ওয়ার্কশপে গিয়ে দেখি, দক্ষ মেকানিকরা পুরোনো গাড়িগুলোকে যত্নে ফিরিয়ে দিচ্ছেন নতুন প্রাণ।
প্রতিটি গাড়িই যেন সময়ের গল্প বলছে—একেকটি চরিত্র, যারা অতীতের ধুলোমাখা অধ্যায় থেকে উঠে এসে বর্তমানকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। পায়ানার প্রতিটি মুহূর্ত এক গভীর অভিজ্ঞতা—যেখানে প্রযুক্তি, শিল্প ও ইতিহাস মিলে এক অনবদ্য আবেশ তৈরি করে।
আপনিও যদি মহীশূরের পথে কোনোদিন যান, তবে একটু সময় নিয়ে থেমে যান পায়ানায়। এখানে সময় যেন ধীরে বয়ে চলে—প্রতিটি গাড়ি হয়ে ওঠে একেকটি গল্প, ইতিহাস ও আবেগের জার্নি।