বাংলাদেশের কমপক্ষে নয়টি ব্যাংক গ্রাহকদের চাহিদা মতো টাকা দিতে পারছে না। কোনো কোনো ব্যাংক সারাদিন বসিয়ে রেখে গ্রাহকদের টাকা না দিয়ে পরের দিন যেতে বলছে।
প্রায় প্রতিদিনই ব্যাংকগুলোতে গ্রাহকদের সঙ্গে ঝামেলা হচ্ছে। গ্রাহকরা ব্যাংকে জমানো টাকা নিয়ে আতঙ্কে আছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে এরইমধ্যে তারা অন্য সবল ব্যাংকের মাধ্যমে সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা দিয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজে কোনো টাকা দেবে না।
যে ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের চাহিদা মতো টাকা দিতে পারছে না সেগুলো হলো :
- ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ,
- সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক,
- গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক,
- ইউনিয়ন ব্যাংক,
- ন্যাশনাল ব্যাংক,
- এক্সিম ব্যাংক,
- আইসিবি ইসলামী ব্যাংক এবং
- ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক।
গ্রাহকদের অভিজ্ঞতা : ঢাকার কারওয়ান বাজারে ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের গ্রাহক মুশফিকা নাজনীন। ওই ব্যাংকে তার কয়েক লাখ টাকা আমানত আছে। তিনি বলেন, ‘‘এই ব্যাংকে আমার স্থায়ী আমানত এবং সঞ্চয়ী হিসাব আছে। ব্যাংক গত দুই মাস ধরে এক দিনে পাঁচ হাজার টাকার বেশি দিচ্ছে না। সামনের মাসে নাকি দিনে দুই হাজার টাকার বেশি পাওয়া যাবে না। নাজনীন জানান, ‘‘আমি আতঙ্কে আছি যে, শেষ পর্যন্ত আমার টাকা ব্যাংক থেকে তুলতে পারব কিনা।”
আরেক গ্রাহক দীপু সিকদার বলেন, ‘‘এই ব্যাংকে আমার স্যালারি অ্যাকাউন্ট। প্রতি মাসে আমার বেতন জমা হলেও তা একবারে তুলতে পারি না। প্রতিদিন পাঁচ বা দুই হাজার টাকা করে তুলি।
আজ (গতকাল বৃহস্পতিবার) কয়েক ঘণ্টা বসিয়ে রেখে শেষ পর্যন্ত আমাকে টাকা দেয়নি।’’ ‘‘আমি বাসা ভাড়া দিতে পারি না, বাচ্চাদের স্কুলের বেতন দিতে পারি না। হাসপাতালের বিল দিলেও ব্যাংক টাকা দেয় না,’’ বলে জানান তিনি।
আরো কয়েকটি দুর্বল ব্যাংকের গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ব্যাংকগুলো দুপুরের পর টাকা দেয়। গ্রাহকরা সকালে গিয়ে বসে থাকেন। দুপুরের পর ব্রাঞ্চ ম্যানেজারেরা হেড অফিস থেকে কিছু টাকা নিয়ে আসেন। তারপর সেই টাকা গ্রাহক হিসাব করে ভাগ করে দেন। কেউ পাঁচ হাজার, কেউ ১০ হাজার এবং কেউ দুই হাজার টাকা পান। আবার কেউ খালি হাতে ফিরে যান।
শাকের আরজু নামের একজন গ্রাহক জানান, ‘‘বৃহস্পতিবার ছয় ঘণ্টা বসে থেকে কারওয়ান বাজারের ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক থেকে পাঁচ হাজার টাকা পেয়েছি। মাসের খরচের টাকা তুলতে প্রতিদিনই ব্যাংকে যেতে হয়৷ অন্য কাজ ফেলে ব্যাংকে বসে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা।” ওই ব্রাঞ্চের ম্যানেজার টুটুল আহমেদ বলেন, ‘‘আমরা যে তারল্য সংকটে ভুগছি এটা তো সবার জানা৷ আমাদের পক্ষে গ্রাহকের চাহিদা মতো টাকা দেয়া আপাতত সম্ভব নয়। আমরা চেষ্টা করছি। আশা করি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হব।”
ঘাটতির পরিমাণ : বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ৯টি ব্যাংকের চলতি হিসাবের ঘাটতি ১৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এস আলমমুক্ত করা ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাত হাজার ২৬৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকার ঘাটতি রয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তিন হাজার ৩৯৪ কোটি টাকার ঘাটতি স্যোশাল ইসলামী ব্যাংকের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, টাকা ছাপিয়ে ওই সব ব্যাংককে দেয়া হবে না।
যেসব ব্যাংকে উদ্বৃত্ত তারল্য আছে তাদের দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ঋণ দিতে বলা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গ্যাারান্টার হবে। তবে তাতে তেমন সাড়া মিলছে না। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদও বলেছেন, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সরকারের দিক থেকে কোনো টাকা দেয়া হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিনা প্রয়োজনে গ্রাহকদের ওইসব ব্যাংক থেকে টাকা না তোলার অনুরোধ করা হয়েছে।
বিশ্লেষকদের পরামর্শ : অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশিদ বলেন, ‘‘বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকগুলোকে দুর্বল ব্যাংককে সহায়তা করতে হবে। আরেকটি বিষয় হলো দুর্বল ব্যাংকগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। মানুষ যদি ভয় পেয়ে ব্যাংক থেকে তাদের টাকা প্রয়োজন না হলেও তুলে নেয় তাহলে দুর্বল ব্যাংক আরো দুর্বল হয়ে পড়বে। এই ক্ষেত্রে গ্রাহকদের যেমন দায়িত্ব আছে, তেমনি বাংলাদেশ ব্যাংকেরও দায়িত্ব আছে। যদি বাংলাদেশ ব্যাংক বলে বিনা প্রয়োজনে কেউ টাকা তুলবেন না তাহলে তো প্যানিক ছাড়াবে। টাকা তোলার জন্য মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়বে।কমিউনকেশন একটি বড় কথা। সেই কমিউনিকেশনে দুর্বলতা থাকলে হবে না। আস্থার জায়গা সৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে।’’
যমুনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নুরুল আমিন বলেন, ‘‘ওই ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী তাদের আমানত থেকে টাকা দিতে আইন অনুযায়ী বাধ্য। কিন্তু তারা সারেন্ডার করছে। গ্রাহক যদি চেক ডিসঅনার করাতে পারেন তাহলে সে আইনের আশ্রয় নিতে পারে। কিন্তু সেটা তো তারা করছে না। তারা চেক ফিরিয়ে দিচ্ছে।’’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘গ্রাহকরা যদি টাকা না পান এই অবস্থায় তাদের তেমন কিছু করার নেই। শুধুমাত্র ব্যাংক দেউলিয়া হলে একজন গ্রাহক যত টাকাই ব্যাংকে জমা রাখুন না কেন সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা পাবেন। তবে বাংলাদেশে ব্যাংক দেউলিয়া ঘোষণার রেকর্ড নাই।’’
মো. নুরুল আমিন বলেন, ‘‘বাংলাদেশ ব্যাংক যেহেতু ওই ব্যাংকগুলোকে অর্থ সহায়তা দেবে না বলেছে তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত হবে যেসব ব্যাংকের তারল্য বেশি আছে তাদের আরো বেশি টাকা ওই ব্যাংকগুলোকে দিতে উৎসাহিত করা। আর গ্রাহকদের মধ্যে আস্থা ফেরানোর জন্য কিছু করা। আস্থা ফিরলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে খুব বেশি সময় লাগবে না।”
অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক খাত বিশ্লেষক ড. মাহফুজ কবির বলেন, ‘‘ব্যাংকিং খাতে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে লুটপাটের ফলে এই পরিস্থিতি হয়েছে, এটা তো সবার জানা। কিন্তু সেটা বললেই তো আর ব্যাংকগুলোর অবস্থা ভালো হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংককে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।’’ তিনি বলেন, ‘‘বাংলদেশ ব্যাংক টাকা দেবে না সেটা বলে গো ধরে বসে থাকলে হবে না। কারণ, ব্যাংক ও গ্রাহকেরতো অভিভাবক কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাই তাদের উচিত হবে পরিকল্পনা করে টাকা দেয়া। এটা শুরু করলে গ্রাহকদের আস্থা ফিরবে। গ্রাহকের আস্থা ফিরলে ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়াবে। নয়তো পরিস্থতি আরো খারাপ হবে। এক পর্যায়ে তারা হয়তো টাকাই দিতে পারবে না।’’ ড. কবির বলেন, ‘‘বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত এই ব্যাংক খাতে যারা লুটপাটের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি৷ সেটা নেয়াও জরুরি।’’
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা বলেন, ‘‘দুর্বল ব্যাংকগুলো নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন কোনো পরিকল্পনা আপাতত নাই। যেভাবে চলছে সেভাবে চলবে।” গ্রাহকরা চাহিদা মতো টাকা তুলতে পারবেন কিনা, না পারলে সমাধান কী? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘নতুন কোনো সমাধান নেই, এভাবেই চলবে।’’
সূত্র : ডয়েচে ভেলে।
এনইউ/জই