মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫

সামারকান্দের দুই প্রসিদ্ধ অলি ও নবী দানিয়েল ( আ:) এর মাজার পরিদর্শন

২৫ অক্টোবর’ ২০২৩  (মঙ্গলবার), আজ আমাদের উজবেকিস্থানের সামারকন্দ সফরের শেষ দিন। আজকে আমাদেরকে খোজা আখররী ভালির মাজার, নবী ডানিয়েলের মাজার ও শাহী জিন্দা কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হবে। শুধু তাই নয় দুপুরে সামারকান্দের একটি গ্রামের পরিবারে আমাদেরকে লাঞ্চ করানো হবে।

সকালে সবাই যথারীতি হোটেলের লবিতে হাজির হয়ে যথাসময়ে বাস আসলে আমরা তাতে উঠে পড়ি। আমাদের গাইড আকু খোজা আখরোর ভালি মাজারের ইতিহাস ও এই গুণী সাধকের জীবন ইতিহাস বলতে থাকেন।

খোজা আখরোর ভালির পুরো নাম নাসির উদ্দিন উবাইদুল্লাহ ইবন মাখমুদ সাকশী (রহ:) । উনি ১৪০৪ সালে মেভেরাননাখোর এর বাগিস্থান গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মধ্য এশিয়ার একজন নামকরা বুজুর্গ ও আধ্যাত্মিক সাধক হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। তিনি খুবই সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা শেখ খোঁজা মাকমুদ নকশাবন্দীর সহযোগী ছিলেন। তিনি কৃষিকাজ ও ব্যবসার কাজে জড়িত ছিলেন। তিনি স্বচ্ছলতায় ও সাধারণ জীবন যাপনের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠেন । তিনি শৈশবে তার সমবয়সী বন্ধুদের সাথে খেলা করার চেয়ে অধিকাংশ সময় মসজিদে ইবাদত বন্দেগীতে মশগুল থাকতে ভালোবাসতেন ।

মাত্র ২৪ বছর বয়সে তিনি নকশাবন্দীর সুফিদের গুরুতে পরিণত হন এবং তাদের আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতা ও সত্য পথ লাভের দীক্ষা দিতে থাকেন। একজন সুফি সাধক হিসেবে তাঁর জীবনের লক্ষ্য ছিল মানুষের আত্মার পরিশুদ্ধতায় কাজ করা, দরিদ্র, অসহায় ও খেটে খাওয়া মানুষদের সাহায্য করা । তাঁর অসংখ্য ভালো কাজের মধ্যে একটি হল তিনি তৎকালীন সময়ে কৃষির উপর ট্যাক্স মওকুফ করান । এছাড়াও তিনি সামারকান্দ, ফারগানা এবং তাসখান্দের শাসকদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করেন। তবে তাঁর জীবনের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ও রহস্যময় ঘটনাটি হল তৎকালীন ভারত শাসক সম্রাট জাহুরুদ্দিন বাবরের দুরারোগ্য রোগের যাদুময়ী আরোগ্য লাভ ।

একদা মোগল সম্রাট বাবর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। কোন ডাক্তার, ঔষধ রোগটি সারাতে পারছিল না। একজন দরিদ্র ব্যক্তি খোজা আখরোর ভ্যালীর কবিতা অনুবাদ করার পরামর্শ দেয় এবং এতে রোগ সারবে জানায় । বাবর নিরুপায় হয়ে এ উপদেশ অনুসরণ করেন এবং এরপর তিনি দ্রুত রোগ থেকে দ্রুত আরোগ্য লাভ করেন যা সকলকে বিস্মিত করে । কথিত আছে যে এই গুণী দরবেশ আল্লাহর সাহায্যে তার জ্ঞানের ক্ষমতা দিয়ে রোগ সারানোর এবং যে কোন কিছুর পরিণাম বলে দেওয়ার ক্ষমতা ছিলো তাঁর। আল্লাহর কুদরতে তাঁর তাবিজ এবং কবিতার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল। তাঁর মৃত্যুর ১৪০ বছর পর তৎকালীন শাসক নদীর দিবানভাগি তাঁর সম্মানে একটি মাজার নির্মাণ করেন। ভবনটির গায়ে বাঘের ছবিটি সুন্দর মোজাইকে কারুকাজ করে অঙ্কিত করা হয়েছে।

এ মাজারে গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন দুটি মসজিদ রয়েছে। উল্লেখ্য সেখানকার বিভিন্ন মাজার ভ্রমণে দেখেছি তারা খুবই ধর্মানুরাগী। মাজারের ইমাম বা আলেম ব্যক্তিদের নিকট তারা তাদের সন্তানদের জন্য দোয়া করে দেবার জন্য নিয়ে আসেন। যেন তাদের সন্তানরাও তাদের মতো আলেম বা বুজুর্গ হয়। এখানেও এক মহিলাকে তার হাতে কাগজপত্রের ফাইল দেখে মনে হলো হয়তো চাকুরীর ইন্টারভিউ বা পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে। মসজিদের ইমামের কাছে দোয়া চাইতে আসতে দেখি। সে একটি বোতলে পানি ভরে আনে। আর ইমাম সাহেব তাতে দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দেন । তাদের নীলাভ টাইলস ও পেইন্টিংসের চকচকে আর্কিটেকচার ডিজাইন অন্যান্য মসজিদ ও মাজারগুলোর মতো এটিও ব্যতিক্রম নয়। এদের বিশাল কাঠের পিলার গুলো প্রায় একই ধরনের কারুকাজ খচিত।

জিয়ারত ও পরিদর্শন শেষে আমরা বাসে উঠে পড়লাম । এবার সামারকান্দের একটি গ্রামের পরিবারে দুপুরের খাবার পরিবেশন করা হবে । বাস ছুটে চলছে। আমরা ছুটে চলছি বিভিন্ন ফল, সবজির ক্ষেত অতিক্রম করে। দু’পাশের প্রকৃতির মনোরম দৃশ্য আমরা উপভোগ করতে থাকি । তরমুজ, সামান, আখরোট, আনার, আপেল, টমেটোর মত দেখতে পার্সিমন ফল গাছ দেখা যায়। চাষিরা ক্ষেতে কাজ করছেন, কেউ বা পরিষ্কার করছেন। আমাদের গ্রামগুলোর বাড়ির মত, গ্রামের বাড়িতে আমরা হাজির হই। তাদের ঘর গুলো বিশাল গুদাম ঘরের মতো মাটির তৈরি। বাড়ির সামনে দুই পাশে বড় বড় আপেল,আনার, আঙ্গুর ঝুলে আছে। থোকা থোকা আঙ্গুর গুলো শুকিয়ে কিসমিস হয়ে গেছে। আমরা এমন বাগান দেখে সেখান থেকে আঙ্গুর, আপেল পেরে খেতে থাকি।

তারা আমাদেরকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায়। আমরা যোহরের নামাজের ওয়াক্ত হওয়ায় পাক পবিত্র হয়ে নামাজের জন্য ব্যস্ত হই। তাদের দোতলার ফ্লোর কাঠের ও কার্পেট মোড়ানো। অন্দরমহলে বর্গাকৃতি উঠানেও বাগান রয়েছে । আর এর চারপাশে বারান্দা সহ দোতলা। দোতালায় বিশাল একটি ঘরে কার্পেট মোড়ানো রুমে মহিলাদের নামাজ পড়তে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাদের আহসান মঞ্জিলের মতো ঘরগুলোর দরজা জানালার দোতলা বাড়ি । আমাদেরকে খাবার পরিবেশনের জন্য বাড়ির মহিলারা রান্নার কাজে ভীষণ ব্যস্ত ছিল। আমরা তাদের রান্না ঘরে কাজ দেখতে থাকি। তারা হাসিমুখে আমাদেরকে তাদের কাজ দেখায়। নিচের তলার বারান্দায় টেবিলে রাখা রান্নার সরঞ্জামাদি দিয়ে কয়েকজন মহিলা তাদের ঐতিহ্যবাহী খাবার পিলাভ বিশাল কড়াইয়ে রান্না করতে থাকেন। আমরা তাদের রান্না উপভোগ করি ।

প্রায় ঘন্টাখানেকের মধ্যে তারা খাবার পরিবেশন করে। দোতালায় বেশ লম্বা রুমে দুই পাশের এক পাশে মহিলাদের জন্য এবং অপর পাশে পুরুষদের জন্য দুইটি ডাইনিংয়ে খাবার পরিবেশন করে। প্রথমে তাদের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন রকম ফ্রুটস, সালাদ, স্যুপ এরপর প্রধান ডিশ, পিলাভ (অনেকটা আমাদের কাচ্চি বিরিয়ানির মত) পরিবেশন করে। তাদের ঐতিহ্যবাহী গ্রীন টি পান করার জন্য ছোট ছোট বাটি ও সিরামিকের কেতলিতে চা দেওয়া হয়। সবার শেষে মজাদার চিজ কেক ডেজার্ট হিসেবে পরিবেশন করা হয়। আমরা খুবই ক্ষুধার্ত ছিলাম । আলহামদুলিল্লাহ! সবাই দুপুরের ভোজ খুবই তৃপ্তি সহকারে উপভোগ করি । এত বড় আয়োজন। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় যে তারা খুবই বিনয়ী ও শান্তিপ্রিয় জাতি । কোথাও কোন হৈ-হুল্লোড় দেখিনি । সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা বিদায় নিই ।

এ বার ডানিয়েল নবীর মাজার দেখতে যাব । এ বিখ্যাত ধর্মপ্রচারক বিভিন্ন ধর্মে বিভিন্ন নামে পরিচিত। মুসলমানরা তাকে বলেন, খোজা ডানিয়াল, ইহুদিরা বলে, দেনিয়েল আর খ্রিস্টানদের নিকট তিনি নবী ডানিয়েল নামে সুপরিচিত। ইতিহাসে ডানিয়েল একজন ভবিষ্যৎবর্ণনাকারী, স্বপ্নের তাবিরকারী ছিলেন। তিনি ব্যবিলন রাজার উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। রাজা নেবুচাঁদনেজার কর্তৃক জেরুজালেম অধিগ্রহণের পর কিশোর বয়সে উনাকে একজন বন্দী হিসেবে অন্যান্য ইহুদীদের সাথে আনা হয়। তাঁর ছিল অসাধারণ স্মরণশক্তি ও জ্ঞানের গভীরতা। তাই খুব দ্রুত তিনি ব্যাবিলনে পরিচিতি লাভ করেন। বেবিলন এর রাজার নিকট উনি কলা ও বিজ্ঞানের সফলতা দেখাতে সক্ষম হন। ফলে রাজা নেবুচাঁদনেজার তাঁকে রাজার স্বপ্নের তাবিরকারী হিসেবে নিয়োগ দেন। তিনি রাজার উপদেষ্টা হিসেবে জনসাধারণকে সাহায্য করেন। এছাড়া ভবিষ্যৎদ্রষ্টা হিসেবে ভবিষ্যতে কি হবে, বিচার কাজে ভবিষ্যতে রাজ্যের অবস্থা, এমনকি হযরত ঈসা (আঃ) এর আগমন বার্তার খবর তিনিই দেন।

ব্যাবিলন রাজ্যের পতনের পর তিনি রাজা দারিউসের জন্য কাজ করেন। তাঁর সুনাম খ্যাতির সাথে সাথে তাঁর বহু শত্রুও ছিল। তারা ষড়যন্ত্র করেন। তাকে বহু প্রভুসহ পারস্য রাজার পূজা করতে বাধ্য করলে তিনি তাতে অস্বীকৃতি জানান। ষড়যন্ত্রকারীরা রাজাকে দানিয়েলকে মৃত্যুদন্ড দিতে হবে তা’ বোঝাতে সক্ষম হন এবং তাকে একটি সিংহের খাঁচার ভিতর ছেড়ে দেয়া হয় । কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে তিনি বেঁচে যান এবং সবাই হতচকিত হয়ে যায়। তিনি পরবর্তীতে আরেকজন পারস্য রাজার ‘CYRUS THE GREAT’ (যাকে কুরআন বর্ণিত জুলকারনাইন মনে করা হয়) বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে কাজ করেন। তিনি সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও নিজ জন্মভূমিতে ফিরে না গিয়ে বেবিলনে থেকে যান এবং সুসা (ইরানে অবস্থিত) শহরে মারা যান ও সেখানে সমাহিত হন। এ নিয়ে বহু বিতর্ক রয়েছে যে তাহলে সামারখান্দে দানিয়েলের কবর কিভাবে আসে? ঘটনা হলো বীরযোদ্ধা আমুর তৈমুর সাত বছর এশিয়া মাইনরে সুসা নগরী দখল করতে চান । কিন্তু তিনি সফল হচ্ছিলেন না। সেখানকার স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে জানতে পারলেন দানিয়েল নবী সুসা নগরীতে সমাহিত থাকবার কারণে এই নগরী অপ্রতিরোধ্য । অতঃপর তৈমুর শহরবাসীর সাথে সমঝোতা করেন এক শর্তে যে তিনি যাওয়ার সময় দানিয়াল নবীর পবিত্র দেহাবশেষের কিছু নিয়ে সামারখান্দ যাবেন । আর তা সামারখান্দে সমাধিস্থ করে এ মাজার গড়ে তোলা হয়। কথিত আছে এরপর থেকে সামারখান্দ আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং ইন্দুস নদী থেকে কৃষ্ণসাগরের তীর পর্যন্ত তাঁর রাজত্ব গড়ে উঠে। যার রাজধানী ছিল সামারখান্দ ।

ইতিহাসের গল্প শুনতে শুনতে আমাদের গাড়ি সিয়াব নদীর তীরে উঁচু পাহাড়ে অবস্থিত ডানিয়াল নবীর মাজারের কাছে চলে আসি। হালকা ঠান্ডা বাতাস বইছে। অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে আমরা পাহাড়ের উপর মাজারে চলে আসি৷ প্রায় ১৮ মিটার লম্বা সমাধি । বিভিন্ন সূত্রে একে ডানিয়েলের সমাধিস্থল আবার কারো কারো মতে সাহাবী কোসেম ইবনে আব্বাস(রা:) এর সহযোগী খোজা ডোনিয়াল এর সমাধিস্থল বলা হয় । সমাধিটি লম্বা হওয়ার কারণ হিসেবে জানা যায় কেউ যেন আসল সমাধির জায়গা চিহ্নিত করতে না পারে এবং দেহাবশেষ চুরি করতে না পারে, তাই সমাধিটিকে লম্বা করা হয়েছে। এর উপরে সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত সোনালী ক্যালিওগ্রাফীতে অঙ্কিত বিশাল কালো চাদরে আবৃত রয়েছে। অতঃপর কবর জিয়ারত শেষে পরন্ত বিকেলে সূর্যের আলোতে হলুদ লালচে গাছপালাগুলো দেখে ইউরোপের মতো মনে হচ্ছিল । সেখানকার নির্মল প্রকৃতির শোভা উপভোগ করতে থাকি,আর সফর সংগীরা সবাই ছবি তুলতে থাকেন। পরিষ্কার পানি পাহাড়ের নিচে অবস্থিত খালের মত নদীতে বয়ে চলেছে।

এবার সামারখান্দের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ‘শাহী জিন্দা কমপ্লেক্স’ ও এরপর এখানকার স্থানীয়দের কাছে প্রিয় ও প্রসিদ্ধ মার্কেট শিয়াব বাজারে নিয়ে যাওয়া হবে । যা পরবর্তী সংখ্যায় বর্ণিত হবে । ইনশাআল্লাহ্ ।
– (চলবে)-

লেখক – পর্যটক, কলামিস্ট, নারী উন্নয়ন কর্মী ও শিক্ষাবিদ, প্রিন্সিপ্যাল, চিটাগং ভিক্টোরী ন্যাশনাল স্কুল- সিভিএনএস

সর্বশেষ

এই বিভাগের আরও খবর