শুক্রবার, ২১ মার্চ ২০২৫

পূর্ণমাস সিয়াম, পূর্ণমাস ক্বিয়াম চাই

ড. মুহাম্মদ নুর হোসাইন

পবিত্র রমজান মুছলিম উম্মাহর জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ মাস। মহাগ্রন্থ আল-কুরআন এ মাসে অবতীর্ণ হয়েছে। এ মাসে সিয়াম সাধনা করা প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক ও সুস্থ নর-নারীর ওপর ফরজ।

রাতে ক্বিয়াম করা তথা ২০ রাকাত তারাবিহর নামায আদায় করা সামর্থ্যবানদের জন্য সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। তারাবিহর নামাযে এক খতম কুরআন পড়া বা শুনা চার মাজহাবের ইমামগণের মতে মুস্তাহাব।

প্রতি রাকাতে ১০ আয়াত থেকে সর্বোচ্চ ২৫ আয়াত পড়ার কথা ইমামগণ বলেছেন। তবে মুছল্লিদের যেন কষ্ট না হয় এবং রমজানের মধ্যে অন্তত একবার খতম করা যায়, সেই দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়।

এর মূল উদ্দেশ্য হলো ক্বিয়াম, যা নামাযের মধ্যে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত বা শ্রবনের মাধ্যমে আদায় করা হয়। এ ব্যাপারে সাহাবাগণের (র.) ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় অদ্যাবধি মুছলিম সমাজ রমজান মাসব্যাপী খতমে কুরআন করে আসছেন।

পরিশুদ্ধ, প্রশিক্ষিত ও ধর্য্যশীল মানুষ হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয় এ সিয়াম সাধনা ও ক্বিয়ামের মাধ্যমে। সিয়াম ও ক্বিয়ামের মাধ্যমে বান্দার অতীতের পাপ মোচন হয়ে যায়।

রাসূলুল্লাহ (দ.) বলেন, “যে ব্যক্তি রমজানে সিয়াম সাধনা করবে আল্লাহ তায়ালা তার অতীতের পাপ মোচন করবেন। যে ব্যক্তি রমজানের রাতে ক্বিয়াম করবেন আল্লাহ তায়ালা তার অতীতের পাপ মোচন করবেন এবং যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ক্বিয়াম করবেন আল্লাহ তায়ালা তার অতীতের পাপ মোচন করবেন” (ছহিহ বুখারি-১৯০৪, ছহিহ মুছলিম-৭৫৯)।

অন্তত একবার পুরা কুরআন শরিফ পড়া ও শুনার মাধ্যমে পবিত্র কুরআনের সমস্ত আদেশ-নিষেধ-উপদেশ সম্পর্কে জানার সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হয় পবিত্র রমজানে, যদিও সবাই পবিত্র কুরআন বুঝেন না। এটি সবার জন্য আবশ্যকও না।

অর্থ না বুঝলেও পবিত্র কুরআন পড়ার ও শুনার প্রতি প্রত্যেক মুসলমানের ভীষণ আগ্রহ রয়েছে। বিশেষত পবিত্র রমজানে মুছল্লিতে মসজিদ ভর্তি হয়ে যায়। তারাবিহ আদায় করার প্রতি অন্য রকম আকর্ষণ দেখা যায়।

রমজানে দুয়েক মাস আগ থেকে প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় হাফেজ নিয়োগের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। রমজানে মুছল্লিদের মাঝে বিশেষ আমেজ অনুভূত হয়।

কারণ, আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য পানাহার ও সর্বযৌন চর্চা থেকে বিরত থেকে পরিশুদ্ধ আত্মার অধিকারী ও সংযমী মানুষ হওয়ার সাধনার নাম সিয়াম সাধনা।

অপরের দুঃখ বুঝা এবং পরস্পর প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করার শিক্ষাও রয়েছে সিয়াম সাধনার মধ্যে। এর সাথে পবিত্র কুরআনের তিলাওয়াত ও শ্রবন নিবিড়ভাবে জড়িত।

কিন্তু সিয়াম সাধনার সাথে তারাবিহর সম্পর্ক না বুঝা, তারাবিহর সুন্নাহ সম্পর্কে জ্ঞান না থাকা, কোথাও কোথাও প্রচলিত নিয়ম রক্ষা করা, কোনো রকমে এক খতম শেষ করা, ব্যবসায় বিঘ্ন ঘটা, দূরে কোথাও বা ঈদের ছুটিতে গেলে খতম ছুটে যাওয়া ইত্যাদির চিন্তায় বাংলাদেশের প্রায় মসজিদে সুন্নতি পদ্ধতির পরিবর্তে ১৫ বা ২০ দিনে খতম করার পদ্ধতি চালু রয়েছে।

কোথাও কোথাও তার চেয়ে কম সময়েও খতম করা হয়। ফলে খতমে তারাবিহর উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। যেমন,

এক. মাসব্যাপী ক্বিয়াম করা হয় না। অথচ সিয়াম সাধনা যেমন মাসব্যাপী ক্বিয়ামও মাসব্যাপী।

দুই. তিলাওয়াত ও শ্রবনের হক আদায় হয় না। অথচ পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত তারতিলের সাথে তথা ধীরস্থিরভাবে, তাজবিদ সহকারে এবং প্রতিটি শব্দ বুঝা যায় মত আদায় করতে হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তোমরা তারতিলের সাথে কুরআন তিলাওয়াত করো” (সূরা মুজ্জাম্মিলল: ৪)।

তিন. সারাদিন সিয়াম সাধনা সহ অন্যান্য দায়িত্ব পালন করার পর দুই/তিন/চার পারা পড়া বা শোনা কষ্টকর হয়।

চার. একজন হাফেজের পক্ষে এক পারা পড়া যেখানে কঠিন সেখানে তার চেয়ে বেশি পড়া শুধু কষ্টকর না, অমানবিকও বটে।

পাঁচ. ৫/১০/১৫/২০ দিনে তারাবিহ শেষ করার পর বাকি দিনগুলোতে অনেকের নামায, তিলাওয়াত, এমনকি রোজাও ছুটে যায়। পূর্ণমাসের তারাবিহ ধরলে সেটি হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। খতমে তারাবিহর তাগিদে মসজিদমুখী হয়ে থাকতে হয়।

রমজানের প্রথম দশকের চেয়ে দ্বিতীয় দশক এবং দ্বিতীয় দশকের চেয়ে তৃতীয় দশক গুরুত্বপূর্ণ। লাইলাতুল কদর বা পবিত্র কুরআন অবতীর্ণের রাত শেষ দশকে। তাই ই‘তিকাফ করা হয় শেষ দশকে।

রাসূলুল্লাহ (দ.) রমজান শেষ দশকে লাইলাতুল কদর তালাশ করার নির্দেশ দিয়েছেন, যে রাতকে হাজার মাসের শ্রেষ্ঠ বলে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা দিয়েছেন এবং রাতের গুরুত্বের ওপর একটি স্বতন্ত্র সূরা অবতীর্ণ করেছেন।

সেই এক রাত ইবাদত করলে আশি বছরের বেশি দিনের ছাওয়াব পাওয়া যায়। এমন গুরুত্বপূর্ণ রাতগুলো খতমে তারাবিহ না করা মানে মূল সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত থেকে বঞ্চিত হওয়া।

পক্ষান্তরে ২৭ রমজান বা ৩০ দিনে খতমে তারাবিহ না করার কারণে অনেকের শুধু সুন্নাত-মুস্তাহাব ছুটে যায় না, ফরজও ছুটে যায়। খতমে তারাবিহ চলাকালীন নিয়মিত জামাতে নামায আদায় সহ সময়মত অন্যান্য কাজ যেভাবে করা হয় খতমে তারাবিহ শেষ হয়ে গেলে কেনাকাটা সহ বিভিন্ন অতিরিক্ত ব্যস্ততার কারণে তারাবিহ ছুটে যায়।

এমনকি অনেকের নামাযও ছুটে যায়। প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় ব্যস্ততার মধ্যে রোজাতেও বিঘ্ন ঘটে। অথচ খতমে তারাবিহ হলো মুস্তাহাব, তারাবিহর নামায হলো সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ আর পাঁচ ওয়াক্ত নামায ও রমজান মাসজুড়ে রোজা পালন করা ফরজ।

এমতবস্থায় পবিত্র কুরআন-সুন্নাহ ও ইসলামি শরিয়ার আলোকে এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নির্দেশিত পন্থায় খতমে তারাবিহ করার নির্দেশ জারি করা জরুরি। রমজানের পরিপূর্ণ ফজিলত ও প্রতিদান পেতে হলে এর বিকল্প নেই। তাই নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে তারাবিহর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। যথা,

এক. বাংলাদেশের প্রত্যেক মসজিদে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নির্দেশিত নিয়মে ২৭ রমজান খতমে তারাবিহ এবং একই সময়ে তারাবিহর নামায শুরু করার নির্দেশ জারি করা।

অর্থাৎ প্রথম ৬দিন দেড় পারা এবং পরবর্তী ২১দিন ১ পারা করে তারাবিহ নামাযে এক খতম কুরআন তিলাওয়াত করা এবং প্রতিদিনের তারাবিহ জন্য একই সময় নির্ধারণ করা। এতে পেশাগত কারণে কাউকে অন্যত্র যাতায়াত করতে হলেও তারাবিহর খতম ছুটবে না।

ঈদের ছুটিতে কেউ বাড়িতে গেলে বাংলাদেশের বর্তমান যোগাযোগের ব্যবস্থার উন্নতির ফলে খতম ছুটার সম্ভাবনা নেই। একই সময়ে তারাবিহ শুরু করলে যে-কোনো মুছল্লি যে-কেনো মসজিদে তারাবিহ আদায় করার সুযোগ পাবেন। ফলে তারাবিহ ও তিলাওয়াত কোনোটাই ছুটবে না।

দুই. প্রত্যেক মসজিদে ৩/৪ জন করে হাফেজ নিয়োগ দেওয়া। কারণ, হিফজের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেড়েছে। যত সংখ্যক হাফেজ আছে এবং প্রতি বছর বের হচ্ছে তত সংখ্যক মসজিদ নেই। আর একজন হাফেজ তারাবিহ পড়াতে না পারলে তার হিফজ ধরে রাখা খুবই কঠিন।

তিন. হাফেজদেরকে যথাযথ গুরুত্ব ও মর্যাদা দেওয়া। হাফেজগণ আল্লাহর ওয়াস্তে খতমে তারাবিহর ইমামত করবেন। কিন্তু মুছল্লিগণ তাঁদের পারিশ্রমিকের প্রতি সুদৃষ্টি দেবেন। এতে তাঁরা উৎসাহী হবেন। ইমামতির পারিশ্রমিক নেওয়া শরিয়ত সম্মত।

চার. তারাবিহ চলাকালীন দোকানপাট ও মার্কেট বন্ধ রাখা। অতিপ্রয়োজনীয় দোকানপাট, ফার্মাসি ও হোটেল ছাড়া তারাবিহ চলাকালীন অন্যান্য দোকানপাট ও মার্কেট বন্ধ রাখলে যেমন মনযোগ দিয়ে তারাবিহ আদায় করা যাবে তেমনি ব্যবসায়ীদের বেচাবিক্রির ক্ষেত্রে কেউ কাউকে ছাড়িয়ে যাওয়ার বা কেউ ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না।

পাঁচ. সরকারি ও বেসরকারি সকল মসজিদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে রমজানের জন্য এককালীন বরাদ্দ দেওয়া। পবিত্র রমজানে মসজিদে মুছল্লির সমাগম বেশি হয়। বিভিন্ন খাতে খরচ বেড়ে যায়। পাশাপাশি খতিব-ইমাম-মুয়াজ্জিনদের বোনাস, হাফেজগণের সম্মানী সহ অন্যান্য খাতে খরচ করতে হয়।

তাই সরকারি বিশেষ বরাদ্দ প্রয়োজন। মুছল্লিগণের পাশাপাশি সরকারি বরাদ্দ পেলে পবিত্র রমজানের কর্মসূচিগুলো আরো ভালোভাবে পালন করা সম্ভব হবে। সম্ভব হবে পূর্ণমাস সিয়াম আর পূর্ণমাস ক্বিয়াম করার।

লেখক সহযোগী অধ্যাপক,আরবি বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ

এই বিভাগের আরও খবর