লবণের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় সড়কে লবণ ফেলে ও গায়ে কাফনের কাপড় জড়িয়ে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন কক্সবাজারের প্রান্তিক লবণ চাষিরা।
বুধবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) বেলা ১১টায় চট্টগ্রাম কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়া উপজেলার খুটাখালী এলাকায় এ কর্মসূচি পালন করেন তারা। এ সময় সড়কে এক ঘণ্টা ধরে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে মহাসড়কে যানজটের সৃষ্টি হলে চরম ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা।
এসময় ইন্ডাস্ট্রিয়াল সল্ট নাম দিয়ে চাহিদার অতিরিক্ত শিল্প লবণ আমদানির পায়তারা বন্ধ এবং মাঠ পর্যায়ে উৎপাদিত লবণের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের দাবি জানান প্রান্তিক চাষি ও ব্যবসায়ীরা। আর দাবি পূরণ না হলে পুরো কক্সবাজারে লবণ ফেলে অচল করার হুঁশিয়ারিও দেন তারা।
জানা যায়, বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের খুটাখালী বাজারে জড়ো হতে থাকেন উপকূলের লবণ চাষিরা। চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী, বদরখালী, ঈদগাঁও এবং সদর উপজেলা থেকে আসা চাষিরা মহাসড়কের দু’পাশে ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে দাঁড়িয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন শুরু করেন।
এ সময় হঠাৎ মহাসড়কের মধ্যে ফেলতে থাকেন লবণ। মহাসড়ক অবরোধ করে রাস্তার ওপর করা হয় লবণের স্তূপ। আর তার ওপর কাফনের কাপড় গায়ে দিয়ে লবণ চাষিরা শুরু করে বিক্ষোভ। একইসঙ্গে রাস্তার দুই অংশে মিছিল করে আটকে দেন যানবাহন। এতে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।
লবণ চাষিদের দাবি, মাঠ পর্যায়ে প্রতি কেজি লবণ উৎপাদন খরচ হচ্ছে ১০ টাকার ওপরে। কিন্তু বিক্রি করতে হচ্ছে ৫ টাকায়। এতে লোকসানের কারণে রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছেন তারা।
বদরখালী এলাকার লবণ চাষি সৈয়দ আলম বলেন, লবণের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত না হলে রাস্তায় এসে জীবন দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কারণ চলতি মৌসুমে লবণ উৎপাদনের শুরু থেকেই দাম নিম্নমুখী। জানুয়ারি মাসে ২৬০ টাকায় প্রতিমণ লবণ বিক্রি হলেও এখন দাম কমে ২০০ টাকায় এসেছে। কোথায় যাবে, এই লোকসান কীভাবে পুষিয়ে নেব।
চকরিয়ার চাষি সাইফুল ইসলাম বলেন, লবণ চাষ এবং তা বিক্রি করে আমরা সংসার চালাই। এখন এক কেজি লবণের দাম যদি ৫ টাকা হয়, তাহলে উৎপাদন খরচের আরও ৫ টাকা কে দেবে। এভাবে চলতে থাকলে মাঠ ছেড়ে উঠে আসতে হবে আমাদের।
লবণ চাষি ও ব্যবসায়ী সংগ্রাম পরিষদের দাবি, কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম বাংলাদেশের একমাত্র দেশীয় লবণ উৎপাদন কেন্দ্র। এরমধ্যে প্রায় ৯৫ শতাংশ লবণ উৎপাদন হয় কক্সবাজার জেলায় টেকনাফ, কক্সবাজার সদর, ঈদাগাঁও, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া উপজেলায় এবং অবশিষ্ট ৫ শতাংশ লবণ উৎপাদন হয় চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায়।
গত মৌসুমে প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুকূলে থাকায় দেশীয় উৎপাদিত লবণ দেশের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয়েছে। এমনকি অর্থবছরে উৎপাদিত লবণ চাহিদা মিটিয়ে বর্তমানে আরও ২ লাখ ২২ হাজার মেট্রিক টন লবণ মজুদ রয়েছে। চলতি মৌসুমে প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুকূলে থাকায় লবণ উৎপাদন প্রক্রিয়া ভালোভাবেই চলছে। প্রায় ৬৫ হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদন হয়, যা ক্রমান্বয়ে আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশীয় লবণ শিল্পের সঙ্গে ৬৫ হাজার চাষিসহ ১০ লাখ মানুষ লবণ শিল্পের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত। কিন্তু এ বছর মাঠ পর্যায়ে লবণের উৎপাদন ভালো থাকার পরও এর ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। মাঠ পর্যায়ে বর্তমানে লবণের মণ প্রতি বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২২০ টাকা। অথচ এক মণ লবণের উৎপাদনে ৩০০ টাকা থেকে সাড়ে ৩৫০ টাকা খরচ হচ্ছে।
এ বিষয়ে কক্সবাজার লবণ চাষি ও ব্যবসায়ী সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী খোকন মিয়া বলেন, লবণের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের জন্য সবার হস্তক্ষেপ কামনা করছি। প্রতিটি দফতরে, উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিসিক সবখানে আবেদন করেছি। শেষমেশ ঢাকায় গিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনও করেছি। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। তাই আজকে মহাসড়কের খুটাখালীতে লবণ ফেলে সড়ক অবরোধ করেছি। তারপরও যদি মাঠ পর্যায়ে লবণের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা না হয় তাহলে পুরো কক্সবাজার লবণ ফেলে আমরা অচল করে দেব।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্যমতে, গত মৌসুমে উপকূলের ৬৮ হাজার ৫০৫ একর জমিতে লবণ উৎপাদিত হয়েছিল ২৫ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন, যা বাণিজ্যিকভাবে লবণ উৎপাদন শুরুর ৬৩ বছরে সর্বোচ্চ উৎপাদন। চলতি মৌসুমে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৬ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন। আর গেলো ৪ মাসে লবণ উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৪ লাখ মেট্রিক টন।
এনইউ /জই