মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫

পড়ন্ত বিকেলে সামারকান্দে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ রেগিস্তান স্কয়ারে

২৪ অক্টোবর ২৩ ইং সোমবার গুর-এ-আমুর পরিদর্শন শেষে আমরা ছুটে চলি সমরকান্দের পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণীয় স্থান রেগিস্তান স্কয়ারে । আমরা যখন সেখানে পৌঁছি সময়টা ছিল পড়ন্ত বিকেল গোধূলি লগ্নে। এটি অবস্থিত পুরানো সমরকান্দ শহরের প্রবেশ কেন্দ্রে। এটি ২০০১ সালে UNESCO WORLD HERITAGE LIST এর অন্তর্ভুক্ত হয়। এর অপূর্ব নির্মাণশৈলীর জন্য দুনিয়া জোড়া সুনাম ও খ্যাতি রয়েছে। এর মাঝখানের বর্গাকৃতির উন্মুক্ত স্থানটি তিনটি মাদ্রাসা দিয়ে ঘেরা ।গাইড বল্লেন, রেগিস্তান অর্থ বালুকাময় স্থান। অতীতে এ স্থানটি বালি দিয়ে আবৃত থাকবার কারণে এর নাম রেগিস্তান স্কয়ার । প্রথম পর্যায়ে জায়গাটিতে মাদ্রাসা গুলো ছিলনা। পরবর্তীতে এগুলো তৈরি হয় । সে সময় সেখানে তৎকালীন শাসকদের নির্দেশ জারি করার জন্য জন সমাবেশ করে ঘোষণা করা হতো, যেকোন উৎসব পালন করা হতো, যুদ্ধে যাবার পূর্বে সৈন্যদের একত্রিত করা হতো [রেগিস্থান স্কয়ারের আশেপাশে তৎকালীন সময়ে সারিসারি করে পসরা সাজিয়ে বাজার বসতো। সেখানে শিল্পী, কৃষকরা তাদের পণ্য সামগ্রী বিক্রয় করতো। সে সময় সমরকান্দের সকল মূল রাস্তাগুলো এ- রেগিস্থান স্কয়ারের দিকেই ছিল । ফলে এ- স্থান সব সময় কোলাহলপূর্ণ ছিল। তাই অতীত কাল থেকে আজ পর্যন্ত রেগিস্তান স্কয়ার সমরকান্দের সামাজিক জীবনে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ । এতে যে তিনটি মাদ্রাসা রয়েছে, সেগুলো হলো ‘উলুগবেগ’, ‘শোরদর’ ও ‘তিল্লাকোটি’ মাদ্রাসা । এগুলো রেগিস্তান স্কয়ারের মূল আকর্ষণ । বিভিন্ন সময় দু-জন শাসক এগুলো পরিচালনা করেন ।

উলুগবেগ মাদ্রাসাঃ তৈমুরের নাতি উলুগবেগ যিনি একজন গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ ছিলেন ১৪০৯ সালে ‘রেগিস্থান স্কয়ারের’ কর্তৃত্ব পান। তিনি ১৪১৭ সালে সেখানে একটি মাদ্রাসা নির্মাণ করার নির্দেশ দেন। এটি পরবর্তীতে তাঁর সম্মানে উলুগবেগ নামকরণ করা হয় । ‘মাদ্রাসা’ একটি আরবি মূল শব্দ থেকে নেয়া হয়। যার অর্থ ‘শিক্ষাদান ও গ্রহণের স্থান’ । ১৪২০ সালে মাদ্রাসাটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয় । আমরা মাদ্রাসাটি ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। আমাদের গাইড আকু আমাদেরকে মাদ্রাসাটির নির্মাণ, গঠন শৈলী, ইতিহাস সম্পর্কে বলছিলেন। প্রতিটি স্থান সম্পর্কে তার খুব ভালো জ্ঞান আছে বুঝা যায় । রেগিস্তান স্কয়ারের পশ্চিম দিকে মাদ্রাসাটি অবস্থিত। এটি আয়তক্ষেত্র আকৃতির । এর অভ্যন্তরে একটি বর্গাকৃতির খোলা উঠান রয়েছে। এর কক্ষগুলো প্রায় ১০০ জন মানুষের ধারণক্ষমতাসম্পন্ন। মাদ্রাসাটির কোনায় দুটি লম্বা মিনার রয়েছে। বিল্ডিংটির চকচকে পাথরগুলো একে অনবদ্য সৌন্দর্য দান করেছে।মাদ্রাসাটির দেয়ালে পোর্টালটি দশটি তারা দিয়ে আকাশ ও জ্যোতিজগত নির্দেশক । তৎকালীন সময়ে এটি সমরকান্দের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান শিক্ষাকেন্দ্র ছিল। এখানে শিক্ষার্থীদের দর্শন, জ্যোতিবিদ, গণিত, ধর্মতত্ত্ব পাঠদান করা হতো। এতে একটি খানকাহ ও সেখানকার বিক্রেতাদের জন্য বিশ্রামাগার ছিল। যা আরো দু- শতক পর আরো দুইটি মাদ্রাসায় পরিণত করা হয় । আর এভাবে তাদের রেগিস্তান স্কয়ার তিনটি মাদ্রাসার সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে।

শোরদোর মাদ্রাসাঃ এ মাদ্রাসাটি ১৬১২ সালে ইয়ালানতুস বাহাদুর যখন সামারকান্দের আমির হিসেবে নিযুক্ত হন তখন নির্মিত হয় । তিনি একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কমান্ডার ছিলেন । শহরটির শাসক হিসেবে তিনি রেগিস্তান স্কয়ারে আরেকটি মাদ্রাসা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। উলুগবেগ মাদ্রাসার প্রতিচ্ছবি হিসেবে এটি নির্মাণ করার কথা ছিল । কিন্তু প্রায় ২০০শত বছরের পুরানো উলুগবেগ মাদ্রাসার মাটি ততদিনে বসে যায়। ফলে উলুগবেগের খানকায় নির্মিত মাদ্রাসাটি পুরোপুরি উলুগ বেগের প্রতিচ্ছবি হতে পারেনি । সে- সময়ের উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে ১৬৩৬ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। এর নামকরণ করা হয় ‘শোর-দোর’ । নামটি মাদ্রাসার পোর্টালে অঙ্কিত ছবির অনুসরণে নামকরণ করা হয়। দুটি সোনালী বাঘ সূর্যকে তাদের পিছনে ধারণ করে সাদা হরিণের পিছনে ছুটে চলছে। মাদ্রাসার প্রবেশ মুখের দেয়ালে ছবিটি রয়েছে। শের অর্থ সিংহ এবং ‘শোরদোর’ অর্থ ‘সিংহ দ্বারা সজ্জিত’। ছবিটি পরবর্তীতে উজবেকিস্তানের জাতীয় নিদর্শনে পরিণত হয়।

তিল্লাকোরি মাদ্রাসাঃ ‘শোর দোর’ মাদ্রাসা নির্মাণের পর ইয়ালানতুশ বাহাদুর আরো একটি মাদ্রাসা ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। ১৬৪৬ সালে রেগিস্তান স্কয়ারের উত্তরে অবস্থিত বিক্রেতাদের বিশ্রামস্থলে মাদ্রাসা ভবনটি নির্মিত হয়। প্রায় ১৪ বছর নির্মাণ কাজ চলে এবং ১৬৬০ সালে এ নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। এতে নীল ফিরোজার গম্বুজ রয়েছে। যার সম্মুখে দু-পাশে দু’টি মিনারেটও রয়েছে। তিনটি মাদ্রাসা একই স্থানে সমন্বয় সাধন করে সুন্দর আর্কিটেকচার ডিজাইনে তৈরি করা হয় । এর নাম তিল্লাকোরি এর নির্মাতাদের ধন্যবাদ জানিয়ে রাখা হয়। পেইন্টিং এর কাজ করার জন্য শিল্পীরা ‘কুন্দল’ পদ্ধতি ব্যবহার করেন । তিনটি মাদ্রাসার মধ্যে তিল্লাকোরি মাদ্রাসার দেয়ালে শিল্পীদের কারুকাজ খুবই আকর্ষণীয় ছিল। যার উপকরণের মধ্যে স্বর্ণ মন্ডিত বস্তুও ছিল। এর সোনালী রঙ এর কারুকাজ দর্শকের দৃষ্টিকে আকৃষ্ট করে । এর নাম রাখা হয় ‘তিল্লাকোরি’ অর্থ gilded বা ‘স্বর্ণ’ মন্ডিত’। তিনটি মাদ্রাসা সোভিয়েত সরকার ক্ষমতা প্রাপ্ত হওয়ার পর বন্ধ হয়ে যায়। সে সময় ভূমিকম্প, রুক্ষ আবহাওয়ার দরুণ মাদ্রাসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে শিল্পীদের করা অপূর্ব কারুকাজগুলো বিলুপ্তপ্রায় হতে থাকে । কিন্তু সে সময় সোভিয়েত সরকার মাদ্রাসা ভবন সংরক্ষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং এর সাথে তৎকালীন সিল্ক বা রেশম সড়কের সংযোগ থাকায় একে ঐতিহাসিক নিদর্শন রূপে মর্যাদা দেয় । বহুদিন ধরে এর কাজ চলতে থাকে এবং সোভিয়েত সরকার পতনের কিছু সময় পূর্বে এর কাজ সম্পন্ন হয়। পূর্বের রেগিস্থানের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার জন্য অসংখ্য শিল্পী সংরক্ষণের কাজে উদ্ধারকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় এবং আজকের রেগিস্তান স্কয়ার তারই ফসল। বর্তমানে কনসার্ট, শহরের কোন দিবস বা অনুষ্ঠান উদযাপন এবং জাতীয় দিবস গুলো এখানে উদযাপন করা হয়। বর্তমান রেগিস্তান স্কয়ার সংলগ্ন বিশাল পার্ক রয়েছে । নানা ফুলের শোভায় সুবাসিত পার্কটিতে মানুষের সমাগম হয়৷ সবাই পরিবার পরিজন নিয়ে বিকালে ঘুরতে আসে। সেখানে কফি,পাপকর্ণ,চকলেট, আইসক্রিমেরও দোকান আছে। রেগিস্তান স্কয়ারে প্রবেশ করে ঘুরতে থাকি । আর আমাদের গাইড আকু আমাদেরকে এর বৃত্তান্ত বলতে থাকেন। মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীদের অবস্থানের জন্যও কক্ষ রয়েছে। এর দোতালায় উঠার সিঁড়িগুলো খুবই উঁচু ও পাটি সরু। দর্শনার্থী ও পর্যটকদের তাদের গাইড সব ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছেন। চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসছে । আমরা মাদ্রাসার বাইরে সিঁড়িতে সবার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমাদেরকে দেখে সেখানকার স্থানীয় মহিলারা আকারে ইঙ্গিতে কথা বলেন এবং আমাদেরকে জড়িয়ে ধরে ছবি তুলে হাসিমুখে বিদায় নেন। রাতে হোটেলে ফিরে আমরা গতকালের মত ডিনারের জন্য কি খাবো ভাবতে থাকি । হোটেলের কাছেই একটি সুপার শপ আছে । তাই ফ্রেশ হয়ে সেখানে যাই । কলা, বন, আঙ্গুর কিনে ডিনার সারতে রুমে ফিরে আসি। হঠাৎ স্বপন ভাই ফোন দিয়ে জানান এখনই ডিনার না করতে। একটু অপেক্ষা করতে । আমরা হোটেলের সামনে অপেক্ষা করতে থাকি । উনি হোটেল থেকে রাস্তার অপর পাশের একটি দোকান থেকে গোস্তের কিমা দেয়া খুবই সুস্বাদু গরম গরম বেক করা পেটিস এর মত খাবার নিয়ে আসেন। আমরা তৃপ্তি সহকারে রাতের খাবার সারি আর উনার জন্য দোয়া করি।
( চলবে)

লেখক- পর্যটক, কলামিস্ট, নারী উন্নয়ন কর্মী ও শিক্ষাবিদ, প্রিন্সিপ্যাল, চিটাগং ভিক্টোরী ন্যাশনাল স্কুল-সিভিএনএস।

সর্বশেষ

এই বিভাগের আরও খবর