২৪ অক্টোবর ‘২৩ সোমবার হজরত ইমাম বুখারী (রাঃ) এর মাজার জিয়ারত শেষে এ-বার আমাদের গন্তব্য শুধু সামরকান্দে নয় বরং মধ্য এশিয়ার প্রসিদ্ধ ঐতিহ্যবাহী স্থান ‘গুর এ আমুর মাজার কমপ্লেক্স’। এ- অপূর্ব চোখ ধাঁধানো মাজার কমপ্লেক্সে একটি খানকাহ, মোহাম্মদ সুলতানের মাদ্রাসা যিনি আমুর তৈমুর এর নাতি ছিলেন এবং আমুর তৈমুর সহ তার পরবর্তী বংশধরদের মাজার আছে ।
আমাদের গাইড আকু আমুর তৈমুরের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, তাঁকে আপনাদের অনেকেই অপছন্দ করলেও সে আমাদের কাছে জাতীয় হিরো। কারণ ইতিহাস থেকে জানা যায় শহরটিকে ধ্বংস করেছিলেন চেঙ্গিস খান । শহরটি পুনর্জীবিত হয় আরেক খানের হাতে। তবে ইতিহাসে তিনি খান নয় পরিচিতি পেয়েছিলেন খোঁড়া হিসেবে। এটি তার নামের সাথে পদবীর মত জুড়ে যায় । ইতিহাসখ্যাত সে যোদ্ধা, বিজেতা ও শাসক কে সমগ্র দুনিয়া “তৈমুর লং” নামে চেনে। ফার্সি লং শব্দের অর্থ খোঁড়া। তার শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তার বিজয় অভিযানে অন্তরায় হতে পারেনি। সামরকান্দকে তিনি রাজধানী বানিয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে ১৪ শতকে তার সাম্রাজ্য স্থাপন করেন।
তিনি সামারকান্দকে রাজধানী বানিয়েছিলেন। তার সাম্রাজ্যের সমস্ত অঞ্চল থেকে তিনি বিদ্বান ও বিভিন্ন শিল্পের দক্ষ কারিগরদের শুধু নয় বরং প্রতিটি অঞ্চল থেকে সম্পদ এনে সমরকান্দের কোষাগারে জমা করেছিলেন। ইস্পাহান, দিল্লি, তাব্রিজ, দামেস্ক, হেরাত প্রভৃতি শহর থেকে যাবতীয় ভালো সবকিছু নিয়ে সমরকান্দকে তিলোত্তমা নগরী হিসেবে গড়ে তোলেন৷ তৈমুরীয় শাসনকালে সামরকান্দ নীল গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ ও সমাধিসৌধের জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে। এসব স্থাপনা টাইলস ও মোজাইকের চমৎকার কারুকাজের জন্য অনন্যতা লাভ করে যা আজও বিশ্ব পর্যটকদের চোখ জুড়াচ্ছে। সে সময় সিরাজের কারিগররা মোজাইকের কাজের জন্য বিখ্যাত ছিল। তাদেরকে দিয়ে কাজ করানো হয় ।
তৈমুর কেবল বিজেতা ছিলেন না, তিনি একজন বড় নির্মাতাও ছিলেন। যুদ্ধ বিরতির সংক্ষিপ্ত সময়ে তিনি স্থাপনার নির্মাণে ব্যস্ত থাকতেন । তার শাসনামলে নির্মিত স্থাপনাগুলো এখনো সে স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। তেমনই একটি স্থাপনার গায়ে আরবিতে লেখা ‘যদি তুমি আমাদের সম্পর্কে জানতে চাও, তাহলে আমাদের স্থাপনা গুলো নিয়ে গবেষণা কর’। তৈমুর সামরকান্দকে ইসলামী শিল্প ও সংস্কৃতির প্রাণ কেন্দ্রে পরিণত করেন। তখন আনাতোলিয়া থেকে ভারতবর্ষ পর্যন্ত ভূখণ্ড শিল্প, সাহিত্য ও স্থাপত্যকর্মের অনুপ্রেরণা ছিল । সামরকান্দ তৎকালীন সময়ে জ্ঞান বিজ্ঞানের কেন্দ্র ছিল। তারা পারস্য থেকে শিল্পী, স্থপতি ও বিদ্বান ব্যক্তিদের নিজেদের সাম্রাজ্যে নিয়ে আসেন। যাদের অনেকেই পরবর্তীতে সামরকান্দে বসতি স্থাপন করেন। শুধু তৈমুর লংই নয় তার বংশধরদের অনেকেই বিখ্যাত নির্মাতা ছিলেন । অনিন্দ্য সুন্দর কারুকাজ ও সু নিপুন স্থাপত্য শৈলির নিদর্শন স্বরূপ তারা বিভিন্ন সুফির সমাধিসৌধ নির্মাণে প্রত্যক্ষ নির্দেশনা দিয়েছিলেন।
তৈমুর লংএর পর সামরকান্দ সমৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখেন তার নাতি মির্জা মুহাম্মদ তারাখাই ইবনে শাহরুখ। ইতিহাসে তিনি উলুগ বেগ নামেই বিখ্যাত। তিনি জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিতে অবদানের জন্য সুনাম অর্জন করেছিলেন। এ- দুটি বিষয় চর্চার জন্য তিনি সামারকান্দে ‘উলুগ বেগ মাদ্রাসা’ প্রতিষ্ঠিত করেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত হতে জ্যোতিষ শাস্ত্র ও গণিতের বিদ্যার্থীরা তার মাদ্রাসায় আমন্ত্রিত হয় । তিনি সামরকান্দে একটি মান মন্দিরও স্থাপন করেন। তৈমুর লংয়ের শাসনামলে সমরকান্দে স্থাপনা গুলোর মধ্যে ‘গোর বিবি খানম মসজিদ’ ও ‘শাহ-এ জিন্দাহ কমপ্লেক্সের’ নাম উল্লেখযোগ্য। তবে সৌন্দর্য ও নির্মাণশৈলীর দিক দিয়ে গোর-এ আমির স্থাপনাটি সবচেয়ে আকর্ষণীয়। গোর -এ আমির অর্থ ‘আমিরের কবর’ । এটি তৈমুর লংয়ের প্রিয় নাতি মুহাম্মদ সুলতানের সমাধিসৌধ হিসেবে নির্মিত হয় । পরবর্তীতে তৈমুর লংকেও এখানে সমাহিত করা হয়। গোর এ আমির কমপ্লেক্সে তৈমুর লং য়ের বংশধর উমর শেখ, মিরন শাহ, পীর মুহাম্মদ, শাহরুখ ও উলুগ বেগও চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
আমাদের গাইড আকুর কাছ থেকে তৈমুর লংয়ের কাহিনী শুনতে শুনতে আমির তৈমুর কমপ্লেক্সে পৌঁছে যাই । প্রথম দর্শনে বলতে হয় অপূর্ব। পূর্বেই বলা হয় এ-অপূর্ব কমপ্লেক্সে আছে একটি খানাকাহ্, মাদ্রাসা ও আমুর তৈমুর ও তার বংশধরদের মাজার । মাদ্রাসাটি একটি ছোট বিল্ডিং । এর সংলগ্ন উঠান রয়েছে । মাদ্রাসার বিপরীতে খানাকাহ্, একটি বড় হল ও ছোট ছোট কক্ষ অবস্থিত। কক্ষগুলোকে হুজরাহ বলে। তৈমুর লং এর নাতি মোহাম্মদ সুলতানের আদেশে এগুলো তৈরি হয়, যাতে এটি ইসলামিক শিক্ষার কেন্দ্রে পরিণত হয় । কিন্তু ১৪০৩ সালে তার আকস্মিক মৃত্যু হয় । এরপর আমুর তৈমুর এর নির্মাণ কাজ পরিচালনা করেন।
কমপ্লেক্সের খোলা জায়গায় প্রবেশ মুখ দেয়া একটি দেয়াল নির্মিত হয় । চারটি মিনারেট এর কোণাগুলোতে অবস্থিত । মিনারগুলোকে দিল্লিতে অবস্থিত কুতুব মিনারের সাদৃশ্য মনে হয়। প্রবেশ পথে বিশেষ আর্কিটেকচার ডিজাইনে খোদায় করে নাম লেখা মোহাম্মদ ইবনে মাহমুদ ইস্পাহানি । কিন্তু তৈমুর লংও মাজারটি নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পূর্বে ১৪০৫ সালে শীতকালে মারা যান। এরপর এর নির্মাণ কাজ তার নাতি উলুগ বেগ সম্পন্ন করেন ।
গুর ই আমির এ প্রবেশ করে আমরা স্থম্বিত হয়ে যাই । মাজার ঘরের দেয়ালে অপূর্ব কারুকাজ করা । এর গম্বুজের সিলিংয়ের চোখ ধাঁধানো স্থাপত্য শৈলী আমাদেরকে কিছু সময়ের জন্য বাকরুদ্ধ করে দেয় । মাজার ঘরের একদম মাঝখানে তৈমুর লং এর সমাধি । আর আশেপাশের সমাধিগুলো তার উত্তরসূরীদের । সেই সময় পৃথিবীর সেরা স্থাপত্য শৈলীদের দিয়ে যে কাজ করানো হয়েছিল তা এ- নিদর্শনগুলো দেখলেই বুঝা যায় । সেখানে হালকা আলো জ্বালানো রয়েছে যা দেখলে মনে হয় গম্বুজটি অসংখ্য সোনালী তারা খচিত আকাশ । অসাধারণ পেইন্টিংস, নকশা আর মূল্যবান পাথর দিয়ে মাজারের দেয়াল ও গম্বুজে কাজ করা হয়েছে যা আগ্রায় সম্রাট শাহজাহানের তাজমহলের সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায় । কারণ আমুর তৈমুরের উত্তরসুরিরা পরবর্তীতে ভারতের উত্তরে শাসন করেন । তাই কাজগুলোতে কিছুটা সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় । কমপ্লেক্সের খানাকাহ ও মাদ্রাসা এখন চালু অবস্থায় নেই। প্রচুর স্থানীয় দর্শনার্থী ও পর্যটকরা এই কমপ্লেক্স পরিদর্শনে আসেন ।
বাইরে ও ভিতরে তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক, হাতের কারুকাজ করা ব্যাগ, শীতের পোশাক, স্কার্ফ, হাতে তৈরি সিরামিকের সামগ্রী, বিভিন্ন ডিজাইনের মহিলা ও পুরুষদের টুপির পসরা সাজিয়ে দোকানীরা বসেছেন । আমরা সবাই তাদের ঐতিহ্যবাহী সামগ্রী ক্রয় করি । উল্লেখ্য এখানে প্রায় সকল পুরুষকে মাথায় কালো রংয়ের চার কোনা বিশেষ ডিজাইনের টুপি পড়তে দেখা যায়। মহিলারাও অনেকে সুন্দর হাতের কাজ করা টুপি পড়েন যা তাদেরকে মানানসই বলে মনে হয়। অধিকাংশ মহিলাদেরকে মাথায় স্কার্ফ পড়তে দেখেছি। পোশাক পরিচ্ছদে তারা বেশ শালীন ও ইসলামিক সংস্কৃতির অনুসরণ করে । সবার হাসিমাখা মুখ ও আন্তরিক চাহনি আমাদেরকে মুগ্ধ করে । ভাষা অন্তরায় হলেও আমাদেরকে জড়িয়ে ধরে সেখানকার অনেক মহিলা ছবি তুলে আর বুকে হাত দিয়ে বলে ‘রাহমা’ ।
(চলবে)
লেখক – পর্যটক, কলামিস্ট, নারী উন্নয়ন কর্মী ও শিক্ষাবিদ, প্রিন্সিপ্যাল, চিটাগং ভিক্টোরী ন্যাশনাল স্কুল- সিভিএনএস