প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট কর্তৃক চলতি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের ‘বর্ষসেরা দেশ’ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও ভবিষ্যতের জন্য বার্তাবহ।
দ্য ইকোনমিস্টের ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪ সংখ্যার শিরোনাম ছিল ‘BANGLADESH BEGINS AGAIN’. কিসের ভিত্তিতে সারাবিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ‘বর্ষসেরা দেশ’ নির্বাচিত হতে পেরেছে তার ব্যাখ্যা ইকোনমিস্ট দিয়েছে এভাবে- ‘সবচেয়ে ধনী, সুখী বা নৈতিকভাবে শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকারী কি না সেই হিসেবে নয়; সেরা দেশ বেছে নেওয়া হয় আগের ১২ মাসে সবচেয়ে বেশি উন্নতি করেছে কি না সেই বিচারে।’ ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে, ‘আমাদের এবারের বিজয়ী বাংলাদেশ, যারা এক স্বৈরশাসককে উৎখাত করেছে। আগস্টে ছাত্রদের নেতৃত্বে রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়, যিনি সাড়ে ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশটি ১৫ বছর ধরে শাসন করছিলেন। দেশের স্বাধীনতার হিরোর এক কন্যা হিসেবে তিনি একসময় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তিনি দমন-পীড়ন শুরু করেন, নির্বাচনে কারচুপি করেন, বিরোধীদের কারাগারে পাঠান এবং নিরাপত্তাবাহিনীকে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। তাঁর শাসনামলে বিশাল অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। জনগণের অসন্তোষ-ক্ষোভকে আমলে না নিয়ে শক্তি প্রয়োগে দেশ শাসনের পথ বেছে নেওয়া হয়। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত অভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রীর পদে ইস্তফা দিয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হন তিনি।’ সরকারপন্থীসহ অনেকের আশঙ্কা ছিল শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশে প্রতিশোধমূলক হামলা ও হত্যাযজ্ঞ শুরু হবে। এতে বিপুল জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হবে। কিন্তু সে আশঙ্কা সত্য হয়নি। ৮ আগস্ট গঠিত শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার সবকিছু সুন্দরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে। শুধু তাই নয়, ৫ থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সরকারবিহীন বাংলাদেশে সাধারণ মানুষও চরম ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছে। সব বিবেচনায় তাই বাংলাদেশকে ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের ‘বর্ষসেরা দেশ’ নির্বাচিত করা হয়েছে। এটি আমাদের জন্য সম্মান ও গৌরবের, সন্দেহ নেই। তবে এ সম্মান ধরে রাখতে না পারলে ‘বর্ষসেরা ব্যর্থরাষ্ট্র’র তকমাও পেতে পারি আমরা। সংগতকারণে সবক্ষেত্রে সবসময় দায়িত্বশীলতার বিকল্প নেই।
উল্লেখ্য, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের বর্ষসেরা দেশ হিসেবে সিরিয়া নির্বাচিত হতে পারে বলে ধারণা করা হয়েছিল। কারণ বছরের পর বছর ধরে এক রক্তাক্ত লড়াইয়ের পর শেষপর্যন্ত সিরিয়ায় প্রায় ৫৪ বছরের আসাদ পরিবারের স্বৈরশাসনের পতন ঘটেছে। এর জন্য দেশটির জনগণকে অনেক কিছুই বিসর্জন দিতে হয়েছে। দেশটির অসংখ্য নাগরিককে নির্বাসনে যেতে হয়েছে। শরণার্থীশিবিরগুলোতে মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়েছে। বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তি ও বিশ^পরাশক্তির স্বার্থে কারণে যুদ্ধের এক চিরস্থায়ী ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে সিরিয়া। এ ক্ষেত্রে আসাদ নানাভাবে নিজের ক্ষমতা ধরে রেখেছে। এমনকি আরব দেশগুলো তাকে একসময় বয়কট করলেও পরে কাছে টেনে নিয়েছে। এ অবস্থায় সিরিয়ায় বাপ-বেটার পাঁচ দশকের বেশি সময়ের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকামী ও সরকারবিরোধী আন্দোলন অনেকটাই স্থিমিত হয়ে আসছিল মনে হলেও বা বাবা হাফিজ আল আসাদের হাত থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বাশার আল আসাদের ক্ষমতা যখন শত ঝড়ঝঞ্ঝা পেরিয়ে প্রায় পোক্ত হওয়ার পথে, তখনই চলতি ডিসেম্বরের শেষদিকে এলো বিদ্রোহীদের হাতে দামেস্কের পতন ও বাশারের মস্কো পালিয়ে যাওয়ার সংবাদ।
প্রসঙ্গত, শুধুমাত্র ভিন্নমতের কারণে শত শত বছর নিপীড়িত হওয়ায় সংখ্যালঘু আলাওয়াত বা আলাভি সম্প্রদায়ের তরুণরা সিরিয়ায় ফ্রান্সের শাসনামলে দলে দলে যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ফরাসিরা সিরিয়া ছাড়লে আলাভি-পরিচালিত সেনারা হয়ে উঠেন দেশটির ‘ভাগ্য বিধাতা’। সিরিয়ায় প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ সুন্নি হলেও খ্রিষ্টানসহ অন্যদের সমর্থন নিয়ে ১০ শতাংশের শিয়া মতাবলম্বী আলাভিরা দেশ শাসনের ভার নেয়। সেনাকর্মকর্তা ও বাথপার্টির নেতা হাফিজ আল আসাদ দেশটির ১৮তম প্রেসিডেন্ট হন ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে। ক্ষমতায় থাকেন আমৃত্যু। তথা ২০০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তার মৃত্যুর পর প্রেসিডেন্ট হন ছেলে বাশার আল আসাদ। হাফিজ ও বাশারের মূল শক্তি ছিল ‘জাতীয় ঐক্য’। জাতিগতভাবে বহুধাবিভক্ত সিরীয়দের অস্ত্র ও ক্ষমতার জোরে নীরব রাখতে পেরেছিলেন তারা। সমাজতান্ত্রিক বলয়ের সমর্থন নিয়ে পিতা-পুত্র হয়ে উঠেন পশ্চিমের বিরোধীশক্তি। নিজ ভূখণ্ডের বাইরে প্রথম রুশঘাঁটি গড়ে উঠে সিরিয়ায়। তাই এ দেশটিকে নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকা কথা বলতো নিচু সুরে। প্রায় দেড়যুগ আগে আরববসন্ত শুরু হলে পশ্চিমের দেশগুলো যখন দেখলো তাদের পছন্দের নেতাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছে তখন তারা দ্বিমুখী নীতি নেয়। অপছন্দের নেতাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সরব হয়। বাশার যেহেতু পশ্চিমের কাছে ব্রাত্য তাই তিনি পশ্চিমবিরোধী শক্তি হিসেবে নিজেকে দেশে-বিদেশে পরিচিত করার চেষ্টা করেছিলেন। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধে ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের পতন হলে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমবিরোধী মুখ হিসেবে বাশার পরিচিত হতে শুরু করেন। সম্পর্ক জোরদার করেন রাশিয়া, তুরস্ক ও ইরানের সঙ্গে। রাশিয়ার পুতিন সরকার সিরিয়াকে গুরুত্ব দেয় ভূমধ্যসাগরে নিজের অবস্থান জানান দিতে। তুরস্কের রেসিপ এরদোয়ান আসেন ব্যবসার সুবিধা পেতে। ইরানের আয়াতুল্লাহরা দেখেন লেবাননের হিজবুল্লাহদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের সুবর্ণভূমি হিসেবে।
তবে ২০১০ খ্রিস্টাব্দের শুরুতে ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী উত্তর আফ্রিকার তিউনিসিয়ায় ‘আরব বসন্ত’র বাউলা বাতাসে সে দেশের একনায়ক জয়নাল আবেদিন বিন আলির সরকারের পতন ও তার দেশ পালানোর পর সেই বাতাস আরও গতি নিয়ে আঘাত হানে মরক্কো, আলজেরিয়া, লিবিয়া, মিশর, জর্ডান, ইয়েমেন ও বাহরাইনসহ অন্যান্য দেশ ও সিরিয়ায়। আরব বসন্তের জেরে ২০১১ খ্রিস্টাব্দে সমাজতান্ত্রিক বাথ পার্টির একদলীয় শাসনে থাকা সিরিয়ায় গণতান্ত্রিক সরকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। প্রথমে এই আন্দোলনকে সুন্নিপ্রধান সিরিয়ায় শিয়াপন্থি প্রেসিডেন্ট বাশারের বিরুদ্ধে সৌদি ও তুরস্ক সমর্থিত ‘বিশৃঙ্খলা’ হিসেবে আখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। শুধু তাই নয় সেসময় দামেস্কে গণতন্ত্রকামীদের আন্দোলন জোরালো হলে গুরুত্বপূর্ণ কর্তাব্যক্তিরা সরকারের পক্ষত্যাগ করতে শুরু করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে বাশার আল আসাদ সেই আন্দোলন দমন করেন অস্ত্রের জোরে। অস্ত্রের জবাব অস্ত্র দিয়ে দেওয়ার বাসনায় আন্দোলনকারীও হাতে অস্ত্র তুলে নেন। গণতান্ত্রিক আন্দোলন রূপ নেয় গৃহযুদ্ধের। একেক দেশ থেকে পাওয়া সমর্থন নিয়ে বিরোধীরা ভিন্ন ভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়লে সেই সুযোগে হঠাৎ শক্তিশালী হয়ে উঠে সশস্ত্র গোষ্ঠী আইএসআইএল।
তারা বাশার সরকারের পাশাপাশি গণতন্ত্রকামীদেরকেও শত্রু মনে করায় সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ ‘চোরাবালি’র চেহারা পায়। কে যে কার শত্রু তা নিয়েও ধোঁয়াশা তৈরি হয় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। বিশ্ববাসী আগ্রহ হারান সিরিয়ার ঘটনাপ্রবাহে। এমন পরিস্থিতিতে আইএসআইএল বা সংক্ষেপে আইএস যোদ্ধারা সিরিয়ায় শিয়াদের পবিত্রস্থানগুলোয় হামলা চালালে বাশার আল আসাদের সরকারের প্রতি সমর্থন দেয় শিয়াপ্রধান আঞ্চলিক শক্তি ইরান। প্রথমে রুশ সরকার সিরিয়ায় থাকা তাদের নৌঘাঁটি নিয়ে আতঙ্কিত হলেও পরে মিত্র তেহরানকে পাশে পেয়ে বাশার আল আসাদের সমর্থনে সরব হয়ে উঠে মস্কো। আইএস দমনের লক্ষ্য নিয়ে দামেস্কের সঙ্গে তেহরান ও মস্কো জোট বাঁধলে একই উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে আসে যুক্তরাষ্ট্রও। মিত্রদের সহযোগিতায় ওয়াশিংটন ঘাঁটি করে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায়। সুযোগ বুঝে যুদ্ধে জড়ায় বাশার আল আসাদের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ তুরস্কও। এ সুযোগে আসাদ নিজেকে শক্তিশালী করার সুযোগ পান। তবে প্রায় ১৪ বছর লড়াই করে টিকে থাকলেও তিনি মাত্র দুই সপ্তাহের যুদ্ধে কুপোকাত হয়ে গেলেন। কারণ ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া, এবং ইসরায়েলের সাথে ইরান প্রক্সিযুদ্ধে ব্যস্ত হয়ে পড়লে সিরিয়ায় এর প্রভাব পড়ে। ইরান এবং রাশিয়া সিরিয়ার প্রতি আর্থ-সামরিক সমর্থন একেবারেই কমিয়ে দেয়। বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক এবং ইসরায়েল আসাদবিরোধীদের সবধরনের সমর্থন বাড়িয়ে দেয়। ফলে মাত্র ২ সপ্তাহের তুমুল লড়াইয়ে আসাদ বাহিনীর পতন ঘটে। তবে নানা দেশ, মত ও গোষ্ঠীর স্বার্থের দ্বন্দ্বের অবসান না হওয়ায় সিরিয়ার সামনের দিনগুলো মসৃণ নয়। ফলে এতোবড়ো বিজয়ের পরও সিরিয়াকে বর্ষসেরা দেশের সম্মান দেয়া হয়নি। কিন্তু গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য ফ্যাসিস্ট-স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনমানুষের রক্তাক্ত লড়াইয়ে সাফল্য এবং সামনের দিনগুলোতে চরম আত্মত্যাগ ও বিজয়ের লক্ষ-উদ্দেশ্য পূরণের পথ অনেকটাই মসৃণ। তাই ইকোনমিস্ট বাংলাদেশকে ‘বর্ষসেরা দেশ’র সম্মান দিয়েছে।
উল্লেখ্য, এবারের ‘সেরা দেশ’ বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত তালিকায় ছিল পাঁচটি দেশ- বাংলাদেশ, সিরিয়া, আর্জেন্টিনা, দক্ষিণ আফ্রিকা ও পোল্যান্ড। শেষ পর্যন্ত দ্য ইকোনমিস্টের সংবাদদাতাদের মধ্যে ‘উত্তপ্ত বিতর্কে’ বেছে নেওয়া হয় সেরাদের, যেখানে বর্ষসেরা দেশ নির্বাচিত হয় বাংলাদেশ এবং রানারআপ সিরিয়া। ইকোনমিস্টের দৃষ্টিতে একটি ফ্যাসিস্ট-স্বৈরাচারী সরকারের পতনের বিষয়টি নানা কারণে খুবই কঠিন ও তাৎপর্যপূর্ণ। গণতন্ত্রমনা ছাত্র-জনতা সে কঠিন কাজটি চরম ঝুঁকি নিয়ে সম্পন্ন করেছে। একইসঙ্গে সামনের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণের সংগ্রামও সুন্দরভাবে চলমান আছে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং চব্বিশের ‘৩৬ জুলাই’ বিপ্লবের চেতনার আলোকে একটি বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণের কাজে অক্লান্ত চেষ্টা চলছে। ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদলের সময় প্রতিশোধমূলক সহিংসতার ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া তেমন কিছু ঘটেনি। যা ঘটেছে তাও আবার রাজনৈতিক। দীর্ঘদিনের বঞ্চনা ও নিপীড়নের ক্ষোভ থেকে কিছু ঘটনা ঘটেছে। অন্তর্বর্তী সরকার এবং সাধারণ জনগণ এমন প্রতিশোধমূলক ঘটনা প্রতিরোধেও দারুণ ভূমিকা রেখেছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপাসনালয় এবং বাড়ি-ঘরের পাহারা দিয়েছে সাধারণ মানুষ, এমনকি বিভিন্ন মুসলিম ধর্মীয় সংগঠনও এ ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা রেখেছে। শান্তি-সম্প্রীতি বজায় রাখার এমন জনতৎপরতা বিশে^র শান্তিপ্রিয় মানুষদের প্রশংসা কুঁড়িয়েছে। অন্য সবার জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। ইকোনমিস্টের মতে, ‘প্রধান বিরোধীদল বিএনপি দুর্নীতিগ্রস্ত। ইসলামী চরমপন্থাও একটি হুমকি। তবে এখন পর্যন্ত তাদের পরিবর্তন আশাব্যঞ্জক। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আহবান শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে প্রেরণা যোগাচ্ছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘২০২৫ খ্রিস্টাব্দে এই অন্তর্বর্তী সরকারকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক করতে হবে এবং কবে নাগাদ নির্বাচন আয়োজন করা হবে তা নির্ধারণ করতে হবে। এর আগে নিশ্চিত করতে হবে যে দেশটির আদালত নিরপেক্ষভাবে চলছে এবং বিরোধীদলগুলোকে সংগঠিত হওয়ার সময় দেওয়া হয়েছে। এর কোনোটিই সহজ হবে না। তবে একজন স্বৈরশাসককে ক্ষমতাচ্যুত করা এবং আরো উদার সরকার গঠনের পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য আমাদের এ বছরের সেরা দেশ বাংলাদেশ।’ প্রসঙ্গত, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দের বিজয়ী ছিল গ্রিস। দেশটি দীর্ঘ আর্থিক সংকট থেকে নিজেদের টেনে তোলায় এবং একটি সংযত মধ্যপন্থী সরকার পুনর্নির্বাচিত করায় সেরা দেশ নির্বাচিত হয়। এর আগের বছরগুলোর বিজয়ীদের মধ্যে রয়েছে কলম্বিয়া (গৃহযুদ্ধ অবসানের জন্য), ইউক্রেন (রাশিয়ার আগ্রাসন প্রতিরোধের জন্য) এবং মালাউই (গণতন্ত্রায়ণের জন্য)।
বিশ্বখ্যাত সাময়িকী ইকোমিস্টের বিচারে বাংলাদেশ ‘বর্ষসেরা দেশ’ হওয়ার বিষযটি আমাদের জন্য অবশ্যই সম্মান ও গৌরবের। এর মাধ্যমে বিশ^সভায় আমাদের মর্যাদা বেড়েছে। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে বৃটিশ শাসন-অপশাসনের অবসানের মধ্যদিয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি স্বাধীন দেশের জন্ম হয়। বাংলাদেশ নামক জনপদটি তখন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবাদে পাকিস্তানের অঙ্গীভূত হয়। কিন্তু শুরু থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রতি বিমাতাসূলভ আচরণ করে। প্রাপ্য নাগরিক-অধিকার থেকে বঞ্চিত করে; বৈষম্য, শোষণ, বঞ্চনা, নির্যাতন, নিপীড়ন চালিয়ে এ জনপদের মানুষজনকে বিক্ষুব্ধ করে তুলে। কিন্তু ন্যায্যতার পথে না হেঁটে পাক শাসকগোষ্ঠী শক্তি প্রয়োগে সব সমস্যার সমাধানের পথে হাঁটে। শেষপর্যন্ত বাঙালি জাতি লড়াইয়ের মাধ্যমে ফায়সালার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়। এতে তারা জয়ী হয়। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান বাহিনীর সাথে দীর্ঘ নয়মাসের রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিশে^র রাজনৈতিক মানচিত্রে ভাস্বর হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। তখন ন্যায্যতার জন্য লড়াই-সংগ্রাম ও রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন দেশ সৃষ্টির কারণে বিশ্বসভায় বাঙালি জাতির সম্মান ও মর্যাদাপূর্ণ আসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বিশ^বাসী বাঙালি জাতিকে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় আপোষহীন সংগ্রামী ও বীরের জাতি অবিদায় ভূষিত করেছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে স্বাধীনতার পর থেকে যারা দেশ পরিচালনার সুযোগ পেয়েছে, তারা কেউই মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়নে মনোযোগী হয়নি। ফলে জনগণের ন্যায্য অধিকার ভোগের পথ দিন দিন সংকুচিত হয়েছে। বৈষম্য-বঞ্চনা-নির্যাতন-নিপীড়ন স্থায়ী রূপ ধারণ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে দূরে থাকার কারণে বিপরীতে রাষ্ট্র ও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছে বিভিন্ন দুর্বৃত্তচক্র। তারা নানা অবৈধ উপায়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে বৈষম্যের পরিধি বাড়িয়ে দিয়েছে। বিস্তৃত করেছে ধনী-গরীবের ব্যবধান। ফলে বৈষম্য ও দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেছে। গত পনেরো বছরে শেখ হাসিনা সরকারের সময় বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ফ্যাসিবাদী স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। এ সময় জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। চালু হয়েছে লুটপাটের অর্থনীতি। অনিয়ম-দুর্নীতি, অর্থপাচার চরম পর্যায়ে চলে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত অর্থনীতির স্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, গত ১৫ বছরে ১০ শতাংশ মানুষ দেশের ৮৫ শতাংশ সম্পদ ভোগ করছে। এ সময়ে বাংলাদেশে উন্নয়ন বাজেটের ৪০ শতাংশ অর্থ তছরুপ হয়েছে। আমলা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা মিলে চোরতন্ত্র চালিয়েছেন। চামচা পুঁজিবাদ থেকে চোরতন্ত্রে পরিণত হয়েছিল পুরো কাঠামো।
১ ডিসেম্বর ২০২৪, রাজধানীর শেরেবাংলানগরের এনইসি সম্মেলনকক্ষে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সংবাদ সম্মেলনে কমিটির প্রধান ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আইনসভা, নির্বাহী বিভাগসহ সবাই গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে চুরির অংশ হয়ে গেছে। এটাই চোরতন্ত্র। এ জন্য রাজনীতিক, ব্যবসায়ী এবং উর্দি পরা কিংবা উর্দি ছাড়া আমলারা সহযোগী হয়েছে। এই চোরতন্ত্রের উৎস ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচন। চোরতন্ত্রে পরিণত করতে প্রথম দিকে মনে হয়েছিল, রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের ভূমিকা বেশি। শেষের দিকের আলোচনায় উঠে এসেছে, চোরতন্ত্রে পরিণত করার প্রক্রিয়ায় উর্দি পরা কিংবা উর্দি ছাড়া আমলারা বেশি কাজ করেছেন। তাঁর মতে, সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত চারটি খাতের মধ্যে ১ নম্বরে আছে ব্যাংক খাত। দ্বিতীয় স্থানে অবকাঠামো; তৃতীয় স্থানে জ্বালানি এবং চতুর্থ স্থানে তথ্য-প্রযুক্তি খাত রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরে শেখ হাসিনা ও তার পরিবার এবং তাদের সরাসরি প্রশ্রয়ে রাজনীতিবিদ, আমলা, এমপি, মন্ত্রী, পুলিশসহ বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তিরা শুধু দেশের বাইরে টাকাই পাচার করেছেন ৩০ লাখ কোটিরও বেশি। অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন করে দেওয়া শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি পদ্মা সেতু, রেল সংযোগ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও কর্ণফুলী টানেলের মতো মেগাপ্রকল্পের ওপর তাদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলেছে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই সীমাহীন লুটপাট ও অনিয়ম হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত দেড় দশকে দেশে বিভিন্ন খাতে ২৮ ধরনের দুর্নীতি করা হয়েছে। ব্যাংক খাত ছিল সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত খাত। শ্বেতপত্র কমিটির তথ্য বলছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত ১৫ বছরে ব্যাংকখাতে যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ তৈরি হয়েছে, তা দিয়ে ২৪টি পদ্মা সেতু বা ১৪টি মেট্রো রেল নির্মাণ করা যেত। প্রবাসে কর্মী পাঠাতে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো গত ১০ বছরে ভিসার জন্য হুন্ডির মাধ্যমে ১৩ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা লেনদেন করেছে। সিন্ডিকেট এবং এই শোষণমূলক নিয়োগের কারণে অভিবাসী শ্রমিকরা ন্যায্য কর্মসংস্থান থেকে বঞ্চিত হয়েছেন এবং দেশে রেমিট্যান্সের পরিমাণ কমেছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ম তামিম বলেছেন, ‘জ্বালানি খাতে ৩০ থেকে ৩৩ বিলিয়ন ডলার খরচের তথ্য দেখেছি। সেখানে তিন বিলিয়ন ডলার হাতবদল হয়েছে। ঠিকাদারি কাজে প্রতিযোগিতা হয়নি। যারা কাজ পেয়েছে তাদের কাছ থেকেও টাকা নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের অতি উচ্চ টার্গেট সেট করে লুটপাট করা হয়েছে। দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহ আইন দুর্নীতির রাজপথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। সংকট মোকাবেলার জন্য নিজস্ব জ্বালানি উৎপাদনের প্রচেষ্টা বাদ দিয়ে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির চেষ্টা করা হয়েছে।’ ড. মোস্তাফিজুর রহমানের মতে, ‘অনেক মেগাপ্রকল্পই হয়তো প্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ঠিকাদারের কথা অনুযায়ী কয়েক গুণ ব্যয় বাড়িয়ে সেই টাকা পাচার করা হয়েছে।’
অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেছেন, বাংলাদেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা এখন গবেষণার দাবি রাখে।’ বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, ‘পরিসংখ্যান দিয়ে এত দিন উন্নয়ন দেখানো হয়েছে; বাস্তবে তা হয়নি। বিগত সরকারের আমলে এত টাকা পাচার হলো, কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ হলো না, কর্মসংস্থান হলো না, তাহলে এত প্রবৃদ্ধি হয় কিভাবে? অর্থনীতির শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় শক্তির অন্যায্য ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংকের মালিকানা দখলে নেওয়া হয়েছিল। শেখ হাসিনার শাসনামলের গত ১৫ বছরে নিয়মতান্ত্রিকভাবে কর ফাঁকি, কর অব্যাহতির অপব্যবহার ও সরকারি তহবিলের দুর্বল ব্যবস্থাপনার ফলে রাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ থেকে বঞ্চিত হয়েছে, ব্যাহত হয়েছে উন্নয়ন। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ভুল ব্যক্তিদের বরাদ্দ দেওয়ায় লাখ লাখ মানুষ বঞ্চিত হয়েছে।
শুধু তাই নয়, সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থার নামে মেধাবীদেরও বঞ্চিত করা হয়েছে। ফলে কোটা সংস্কারের দাবি উঠে বার বার। কিন্তু কখনো আমলে নেওয়া হয়নি। শেষপর্যন্ত ছাত্ররা জুলাই মাসে কোটা সংস্কারের দাবিতে রাজপথে নামে। সরকার শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি আমলে না নিলে একপর্যায়ে তা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শিক্ষার্থীরা ৯ দফা দাবিতে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলে। কিন্তু সরকার বল প্রয়োগে আন্দোলনের ফায়সালা করা পথ বেছে নিলে জুলাইয়ের শেষদিকে এসে সরকার পতনের একদফায় রূপ নেয়। আইনশৃঙ্খলাবাহিনী এবং সরকারের অঙ্গসংগঠনগুলো শিক্ষার্থীদের সাথে সংঘর্ষ ও ব্যাপক দমন-পীড়ন ও গুলি বর্ষণের ঘটনায় যুক্ত হলে বিভিন্ন পেশাজীবীসহ সর্বস্তরের মানুষ সরকার পতনের আন্দোলনে যুক্ত হয়ে যায়। সরকার কারফিউ জারি করে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দিয়েও আন্দোলন দমাতে পারেনি। শেষ অস্ত্র হিসেবে সরকার মার্শাল ল’ জারির চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। কারণ সেনাবাহিনী জনগণের সাথে থাকার ঘোষণা দিয়ে আন্দোলনকারীদের পাশে থেকেছে। একপর্যায়ে ৫ আগস্ট ‘রোডমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির আওতায় সারাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ গণভবন ঘেরাও করতে গেলে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী পদে ইস্তফা দিয়ে ভারতে চলে যান। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাজপথে মানুষের ঢল নামে। সারাদেশের মানুষ রাজপথে আনন্দমিছিল বের করে। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য! একাত্তরের পর বাংলাদেশে এমন দৃশ্য আর দেখা যায়নি। অনেকে ৫ আগস্টের বিজয়কে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ হিসেবেও চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন।
যদিও ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদ-স্বৈরাচার বিরোধী লড়াইয়ে ছাত্র-জনতার বিজয় ‘বিপ্লব’ নাকি ‘গণঅভ্যুত্থান’ নাকি ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা- এ নিয়ে নানা বিতর্ক ও নানা মত আছে, তবে একটি বিষয় নিশ্চিত যে, সকল অশুভের বিরুদ্ধে শুভশক্তির বিজয় ছিল এটি। মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার যে পথ নির্মাণ করে দিয়েছিল, এতোদিন জনবিরোধী সরকারগুলো সে পথ রূদ্ধ করে দিয়েছিল। যদিও তারা মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলতো, কিন্তু তাদের কাজ এবং আচরণ ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। চব্বিশের ‘৩৬ জুলাই’ বিপ্লব বা অভ্যুত্থান আমাদের একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে যাওয়ার সে পথের সন্ধান দিয়েছে। অনেকে একাত্তর এবং চব্বিশের চেতনাকে আলাদা দৃষ্টিতে দেখার ও ব্যাখ্যার চেষ্টা করছেন। এটি জাতিকে বিভক্ত করার দুরভিসন্ধি ছাড়া আর কিছুই নয়। একটি বৈসম্যহীন, মানবসাম্যের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে চাইলে আমাদের অবশ্যই উদ্ভট এবং দুরভিসন্ধিমূলক বিতর্কে না জড়িয়ে একাত্তর ও চব্বিশের চেতনাকে ধারণ করে স্বপ্নের বাংলাদেশ নির্মাণে যাপিয়ে পড়তে হবে। পরিশুদ্ধ জনমুখী রাজনীতির চর্চা করতে হবে। রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থে দুর্নীতির লাগাম টানতে হবে। রাষ্ট্রের সবখানে সুশাসন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। সরকারকে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ করতে হবে। বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, শিক্ষার মান এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সুস্পষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। ন্যায্যতা, সমতা এবং আত্মমর্যাদার ভিত্তিতে রাষ্ট্র বিনির্মাণের অঙ্গীকার নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। আগামির সব সরকারই জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবে এবং রাষ্ট্রের মালিক হিসেবে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। সাংবিধানিকভাবে সরকারসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরা জনগণের সেবক হিসেবে পরিগণিত ও পরিচিহ্নিত হবে। এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি করতে হবে, যেখানে জবাবদিহিতা হবে প্রাথমিক ভিত্তি। কেননা জবাবদিহিতা না থাকলে কোনো অবস্থাতেই নাগরিকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা হবে না। জনগণের সরকার ছাড়া নাগরিকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে না। তাই প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা চাই, জনগণের ভোটে, তাদের পছন্দের পরীক্ষিত সৎ ও আদর্শবাদী মানুষের নেতৃত্বে গণমানুষের সরকার দেশ শাসন নয়, পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করুক। আমাদের দায়িত্ব হলো আগামী দিনে এমন বাংলাদেশ তৈরি করা, যা মহান একাত্তর ও চব্বিশের চেতনায় এগিয়ে যাবে, যার ভিত্তি হবে গণতন্ত্র ও সুশাসন। যা হবে বৈষম্যহীন মানবসাম্যের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। সুন্দর হোক, কুসুমিত হোক ও সুশোভিত হোক বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ।
লেখক: গণমাধ্যম কর্মী।
এনইউয়/জই