জানুয়ারির মধ্যেই শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার। প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ করে সরকার। বছরের প্রথম দিনে হাসি মুখে সেই বই নিয়ে বাড়ি ফেরে শিক্ষার্থীরা। কোন শ্রেণিতে কয়টি বই পড়ানো হবে তা নির্ধারণ করে দেয় এনসিটিবি। শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি সেটি ঠিক করে।
এনসিটিবির আইনে বলা আছে, বোর্ড কর্তৃক পাঠ্যপুস্তক প্রণীত ও প্রকাশিত নয় অথবা পাঠ্যপুস্তক হিসেবে অনুমোদিত নয় এমন কোনো পুস্তককে কোনো বিদ্যালয়ের জন্য পাঠ্যপুস্তক হিসেবে নির্ধারণ করা যাবে না। এনসিটিবির পাঠক্রম অনুযায়ী নির্ধারিত পাঠ্যবই হলো; ইংরেজি, বাংলা, প্রাথমিক গণিত, পরিবেশ পরিচিতি সমাজ ও বিজ্ঞান, সংগীত, শারীরিক শিক্ষা, চারু ও কারুকলা এবং ধর্ম। কিন্তু সরকারি স্কুল ছাড়া সব বেসরকারি স্কুল, কিন্ডারগার্টেন, ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোতে পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বইয়ের চেয়ে অতিরিক্ত আরও অনেক বই কিনতে হয়। এসব বইয়ের লিস্ট ছাত্রছাত্রীদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। এর পেছনে প্রতিষ্ঠান ভেদে বড় অঙ্কের লেনদেনও হয়। এসব বইয়ের মধ্যে বাংলা, ইংরেজি ও আরবি ওয়ার্ড বুক, ইংলিশ গ্রামার, ট্রানসিলেশন কম্পোজিশন, বিভিন্ন শব্দশৈলী বাংলা-ভাষার ব্যাকরণ ও চিত্রাঙ্কন, গণিত সম্পর্কিত নানান নামের নানান বই। এ বইগুলি পূর্ব বছর কেনা থাকলেও প্রতিবছর সামান্য পরিবর্তন করার কারণে নতুনভাবে কিনতে বাধ্য করা হয়। নতুন বছরে অধিক মূল্যের বই কিনতে অভিভাবকরা হিমশিম খায়। সরকারের নিষেধ থাকার পরও প্রতিবছর এসব বই বিক্রি হচ্ছে। অথচ এসব বইয়ের সবকয়টি ছাত্রছাত্রীরা ঠিকমতো পড়েই না বা স্কুলে পড়ানো হয় না। আজকাল অলিগলি ও বিল্ডিংয়ের দোতলায়, তিনতলায় গড়ে উঠছে কিন্ডারগার্টেন ও বিভিন্ন নামের স্কুল মাদ্রাসা। এসব প্রতিষ্ঠানে পাঠ্যবইয়ের বাইরে বই কিনতে হয়। মাস শেষে মোটা অঙ্কের বেতন দিতে হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে সিলেবাস কী, লাইব্রেরিতে কতগুলো বই আছে, ছাত্রছাত্রীরা পড়ে কিনা তা সরকারিভাবে নজরদারিতে নেই।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অপ্রতুল বা দুর্বলতা থেকে এসব কিন্ডারগার্টেনের জনপ্রিয়তার শুরু । সরকার বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠানে বহু সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছেন। সরকারে উচিত এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাদানের পদ্ধতি এবং তা ব্যবসায়িক মনোভাব নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে কিনা শক্তিশালী নজরদারির ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
একটি শিশুর ওজনের ১০ শতাংশের বেশি তার স্কুল ব্যাগের ওজন হবে না এমনটা নির্দেশনা ছিল মহামান্য হাইকোর্টের তারপরও স্কুল ব্যাগের ওজন থেকে রেহাই পাচ্ছে না শিশুরা। অনেক ক্ষেত্রে শিশুদের স্কুল ব্যাগের ওজন শরীরের ওজনের শতকরা ৩০ ভাগেরও বেশি। হাইকোর্টের বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও আশিস রঞ্জন স্কুল ব্যাগ নিয়ে এই রায় দেন ২০১৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর। এ রায়ের পর আইন না করা এবং নির্দেশনা না মানায় সংশ্লিষ্টরা একটি আদালত অবমাননা আবেদন করেছিলেন।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, ছয় বছরের একটি ছেলেশিশুর আদর্শ ওজন ২০ দশমিক ৬৯ কেজি আর মেয়ের ১৯ দশমিক ৯৫ কেজি। সে হিসাবে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীর ব্যাগের ওজন তার শরীরের ওজনের ১০ শতাংশ অর্থাৎ সর্বোচ্চ দুই কেজি হওয়ার কথা। সেখানে বিভিন্ন স্কুলে প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ব্যাগের ওজন পাওয়া গেছে সর্বনিম্ন তিন থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে পাঁচ কেজি। একদিকে বাড়তি বই পড়ার চাপ, অন্যদিকে কোচিংয়ের চাপ সহ্য করতে না পেরে শিশুরা প্রায়ই অসুস্থ হচ্ছে। শিশুদের পড়াশোনার চাপের জন্য অনেকটাই দায়ী অতিরিক্ত বই। এসব বই ব্যবহার করতেই ছাত্রছাত্রীরা হাঁপিয়ে ওঠে। অতিরিক্ত বই, ক্লাসের খাতা, স্কেল বাক্স, পানির বোতল, টিফিন বক্স সব মিলিয়ে স্কুল ব্যাগের ভারে কুঁজো হয়ে হাঁটছে শিক্ষার্থীরা। তাছাড়া ছেলেমেয়ের ভারী ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে চলেন তাদের মা-বাবা কিংবা অভিভাবকরাও। প্রজ্ঞাপন দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থায় নতুন বছরের শুরুতে অতিরিক্ত বই কেনার আর্থিক ও মানসিক চাপের নির্যাতন হতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকগণ মুক্তি পাবে।
লেখক পরিচিতি : প্রাবন্ধিক ও সংগঠক