শুক্রবার, ২১ মার্চ ২০২৫

হেলাল হাফিজের সেই হেলেন

নেত্রকোণার মগড়া নদী। এই নদীর ধারেই ছবির মত সুন্দর মেঘময় আকাশের নিচে ১২-১৩ বছর বয়সের কিশোর হেলাল হাফিজ প্রেমে পড়েছিলেন হেলেন নামের এক কিশোরীর। দীর্ঘদিনের প্রেম, একসাথে গ্রামের মাঠে মাঠে ছুটে বেড়ানো, নদী থেকে কচুরিপানা তুলে হেলেনের খোপায় গুঁজে দেয়া – কত স্মৃতি, কত ভালোবাসার শৈশব কৈশোর কাটে তাদের একসাথে। কিন্তু তাদের এই সুন্দর প্রেমের উপন্যাসে বাঁধ সাধলো দুই পরিবার। কোনোভাবেই কেউ মেনে নিলো না তাদের এই প্রেমকাহিনী। অভিমান করে ঢাকায় এসে পড়লেন কবি। হেলেনের থেকে অনেক দূরত্ব তখন তার। তবুও মনের মধ্যে আশা রাখেন, একদিন হেলেন তার হবে। কিন্তু তা না হয়ে হুট করে একদিন হেলেনের চিঠি আসলো কবির কাছে – “কবি! আগামীকাল আমার বিয়ে, নেমন্তন্ন রইলো।”

চিঠির দিকে চেয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই তখন করার ছিলো না কবির। লিখলেন,

“হয়তো তোমাকে হারিয়ে দিয়েছি
নয়তো গিয়েছি হেরে,
থাক না ধ্রুপদী অস্পষ্টতা
কে কাকে গেলাম ছেড়ে।’

ধুমধাম করে হেলেনের বিয়ে হয়ে গেলো ঢাকার বিখ্যাত এক সিনেমা হলের (মুন সিনেমা হল) মালিকের সাথে। বিয়ের পরও বারকয়েক হেলেনকে চিঠি দিয়েছিলেন কবি। বারবার লিখতেন, “পত্র দিও, পত্র দিও।” কিন্তু ফিরতি পত্র আর কখনো আসত না কবির ঠিকানায়। এক বুক ভরা বিষণ্ণতা নিয়ে বসে থাকেন কবি, লিখেন :

“প্রতিমা
শুনেছি সুখেই বেশ আছো,
কিছু ভাঙচুর আর
তোলপাড় নিয়ে আজ আমিও সচ্ছল,
টলমল অনেক কষ্টের দামে জীবন গিয়েছে জেনে
মূলতই ভালোবাসা মিলনে মলিন হয়, বিরহে উজ্জ্বল।”

নিজের সব বিষণ্ণতা কবিতার খাতায় তুলে আনেন কবি। সারাদিন পাগলের মত কবিতা লিখেন। কবিতার খাতা ভর্তি করে বইমেলায় বের করলেন তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ – “যে জলে আগুন জ্বলে।”

নিয়তির কি করুণ পরিহাস! বইমেলা থেকে আরো অনেক বই এর সাথে সেই কাব্যগ্রন্থও কিনে আনেন হেলেনের স্বামী। বাসায় বইমেলা থেকে কিনে আনা বই এর মধ্যে নিজের প্রাক্তন প্রেমিকের বই দেখে চমকে উঠেন হেলেন। বই এর পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকেন। কবিতার পর কবিতা পড়ে যেতে থাকেন। প্রতিটা কবিতায় হেলেনকে নিয়ে লেখা কবির আর্তচিৎকার, হাহাকার, পেয়েও হারানো বেদনা হেলেনের বুকের মধ্যে যেয়ে হাতুড়ি পেটা করে। নিজেকে আর বেশিদিন ঠিক রাখতে পারে না হেলেন। ধীরে ধীরে মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটতে থাকে তার। উচ্চতর চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন দেশ ঘুরিয়ে আনলেও হেলেন আর ভালো হয়নি৷ শেষমেশ স্বামীর থেকে তালাকপ্রাপ্তা হয়ে হেলেনের আবার ঠাঁই হয় নেত্রকোণায় তার নিজের বাসায়। হেলেন তখন বদ্ধ উন্মাদ। শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হয় তাকে। এদিকে নিঃসঙ্গ অবস্থায় শাহবাগের মেসে যখন হেলাল হাফিজ তার শেষ দিনগুলা কাটাচ্ছিলেন, ওদিকে হেলেন তখন নেত্রকোণার এক গ্রামে শেকলে বাঁধা অবস্থায় বদ্ধ উন্মাদ অবস্থায় দিনাতিপাত করছিলেন। দুইজনই দুইজনকে ভালোবেসেছিলেন, কিন্তু কারোরই আর কাউকে পাওয়া হয় নাই। নিঃসঙ্গতার কঠিন বেড়াজালে কাটলো তাদের জীবন। মানুষের ভালোবাসা বোধহয় কবির কবিতার পঙক্তির মতই – মিলনে হয় মলিন, বিরহে হয় উজ্জ্বল। কিন্তু সেই উজ্জ্বলতার পাশাপাশি সেই ভালোবাসা মানুষকে অদ্ভুত এক নির্জনতাও উপহার দিয়ে যায়। আর সেই নির্জনতা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়ই বোধহয় মৃত্যু।

মানুষ কি আসলে তার জীবনে কিছু পায়? কাফকা তার জীবনে মিলেনারে পায় নাই, মিলেনার উদ্দেশ্যে কত শত চিঠি লিখে গিয়েছেন, যেগুলার কোনোটা হয়ত মিলেনার হাতেও পৌঁছে নি। এডগার এলান পো এর জীবনেও তার সারাহ কখনো এনাবেল লী হয়ে আসে নাই। জন কীটস তার নিজের অসুস্থতার কারণে পান নাই ফ্যানিকে।
লর্ড বায়রন মেরিকে না পেয়ে কবিতার খাতা খুলে বসেছিলেন, লিখে ফেলেছিলেন তার বিখ্যাত কবিতা The dreamers. দান্তে বিয়াট্রেসকে না পেয়ে তার সব ক্ষোভ রাগ উগরে দিয়েছিলেন দ্য ডিভাইন কমেডিতে। আমাদের জীবননান্দও তার শোভনাকে না পাওয়ার বেদনা ভুলতে লিখলেন বনলতা সেন।

আর তেমনি আমাদের হেলাল হাফিজও পান নাই তার হেলেনকে। এক হেলেনকে না পাওয়ার দুঃখ ভুলতে আমাদের হেলাল হাফিজের এক জীবন কেটে গেলো।

মানুষের জীবনের এই চাওয়া আর পাওয়ার মধ্যে বিস্তর ফারাক। এই ফারাকের ব্যবধানের হিসাব কষতে কষতে মানুষের এক জীবন পার হয়ে যায়, তবুও মানুষের অংক শেষ হয় না। এই কঠিন সমীকরণ মিলাতে যেয়ে মানুষ ভয়াবহ নিঃসঙ্গতায় ডুবে যায়। নিঃসঙ্গতায় ডুবে যেমন ভ্যান গঘ নির্জন এক রাতে ছবি আঁকতে আঁকতে নিজের বুকে গুলি করে পড়ে ছিলেন তার স্টুডিওতে। সারাজীবন মেলানকোলিয়ায় ডুবে থেকে এক শীতের সকালে সূর্য ওঠার আগেই মৃত অবস্থায় পার্কের বেঞ্চে পাওয়া গেলো এডগার এলান পোর মৃতদেহ। নিঃসঙ্গতায় ভর্তি এক জীবন কাটিয়ে জীবনানন্দ পা বাড়ালেন ট্রামলাইনে।

আমাদের হেলাল হাফিজকেও তেমনি পাওয়া গেলো শাহবাগের এক মেসে। নিঃসঙ্গতায় ভরা এক জীবন কাটিয়ে অবশেষে ঘুচলো তার নিঃসঙ্গতা। নিঃসঙ্গতার সমাধান – বোধহয় এই এক মৃত্যু। এছাড়া সেই আদিকাল থেকে শুরু করে কোনো কবি সাহিত্যিকই নিঃসঙ্গতার আর কোনো সমাধান পান নি।

সংগৃহীত

সর্বশেষ

এই বিভাগের আরও খবর