রাজধানী তাসখন্দে পৌঁছে একরাত অবস্থানের পর সমরকন্দের অভিমুখে আজ ২৪ শে অক্টোবর ২০২৩ সোমবার আমাদের উজবেক ভ্রমণের প্রথম দিবস। আমাদেরকে সামরকান্দের ঐতিহাসিক স্থাপনা ও নিদর্শনগুলো দেখানো হবে ।আমাদের গাইড জানালেন আজকে প্রথমে ১৬-১৯ শতকের মাওলানা শরীফ, ইমাম বুখারী সেন্টার পরিদর্শন, এরপর লাঞ্চ, লাঞ্চ এরপর গুর-ই আমুর তৈমুর কমপ্লেক্স এবং রেগিস্থান স্কয়ার ঘুরে দেখনো হবে ।
প্রথমেই মাওলানা শরীফ যা মাকদুমী আজম নামের পরিচিত স্থানটিতে নিয়ে যাওয়া হয় । মাকদুমী আজম কোন ব্যক্তির নাম নয় বরং এটি একটি উপাধি। একে অনুবাদ করলে হয় ‘SUPEREME LORD’। মধ্য এশিয়ায় এই নামে আরো কিছু মাজার আছে যা সামারকান্দে অবস্থিত৷ এতে শায়িত আছেন সাইদ জালাল উদ্দিন আকমাদ আল কাসানী আদ ডাকবেদী (রহ)। এছাড়া তাঁর অনুসারী আরো বহু সুফী সাধকরা৷ তিনি নকশাবন্দী ডাকবেদীয়া সুফী স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন৷ মাজারটি ৬০২ বর্গমিটার এলাকা জুড়ে অবস্থিত । ঐতিহ্যগতভাবে বিল্ডিংটি পোড়া ইট দিয়ে তৈরি৷
গাড়ি থামলে আমরা সবাই এর মনোমুগ্ধকর পরিবেশ দেখে ছবি তুলতে থাকি । নানারংয়ের ফুলের বাগান। কিছুদূর পথ হেঁটে গেলে বহু পুরাতন কাঠের স্তম্ভে কারুকাজ খচিত অসংখ্য পিলারের উপর দাঁড়িয়ে আছে সুন্দর মসজিদ । মোটা কার্পেটে আবৃত মসজিদে আমাদের ভাইদের অনেকে দু’রাকাত নফল নামাজ পড়ে নিলেন।
মসজিদের সামনে ১৫২৮ সালে রোপণ করা প্রায় ৫০০ বছরের পুরানো একটি চিনার বৃক্ষ রয়েছে। বৃক্ষটি বেশ ভালো অবস্থায় আছে। মসজিদ পেরিয়ে কিছুদূর অগ্রসর হলেই তৎকালীন বিভিন্ন সুফী-সাধকদের কবর রয়েছে । এগুলো গম্বুজের মতো কবরস্টাইলে পাকা করে বাধাই করা। কবরগুলো অতিক্রম করে একটি মাদরাসা বা মক্তব অবস্থিত । এখানে পূর্বে পাঠদান করা হতো। কিন্তু বর্তমানে তা চালু নেই। আমরা ওলি বুজুর্গদের কবর যিয়ারত করি এবং মাওলানা গিয়াসউদ্দিন তালুকদার ভাই সফরের নিরাপত্তা ও এই জ্ঞানার্জনের উছিলায় আমাদের সকলের কল্যাণ কামনা করে মোনাজাত করেন। এ সময় আমাদের একজন আপা (সফর সঙ্গী) অসুস্থ হয়ে পড়লে গাইডের কল পেয়ে ১০ মিনিটের মধ্যে ডাক্তার, নার্স এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে চলে আসেন । প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন । অতঃপর পরবর্তী গন্তব্যের জন্য সবাই গাড়িতে ছুটে চলি ।
গাড়ি ছুটে চলছে সমরকান্দ থেকে ২৫ কিঃমিঃ দূরে অবস্থিত খরতান গ্রামে । কারণ সেখানে শায়িত রয়েছেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ট বিশুদ্ধ হাদীস সংগ্রহকারী ও লেখক আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইসমাইল আল বুখারী (রাঃ) । বর্তমানে এই স্থানকে ঘিরে সরকার একটি বিশাল প্রজেক্ট হাতে নিয়েছেন যার কাজ ২০২৩ এ শেষ হবার কথা । প্রায় ৪৮ হাজার বর্গমিটার জায়গা জুড়ে কমপ্লেক্সটি তৈরি করা হচ্ছে। একটি নতুন মসজিদ নির্মানের কাজও চলছে যা প্রায় শেষ পর্যায়ে। এতে ৯০০০ মুসুল্লি একত্রে নামাজ আদায় করতে পারবেন। এছাড়া প্রায় ৪৪০০ বর্গমিটার এলাকাজুড়ে অপূর্ব বাগান করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে যাঁর সংগৃহীত হাদিস পড়ে আমরা বিশুদ্ধ হাদীস গুলো জানতে পারি তাঁর পদধূলায় অংকিত সেই ভূমি দর্শনের জন্যই আমাদের ছুটে আসা, কিন্তু দুঃখের বিষয় পুননির্মাণ কাজ চলার কারণে কমপ্লেক্সের বাইরে থেকে আমাদের মাজার জিয়ারত ও মুনাজাত করতে হয়। কমপ্লেক্সের বাইরে রাস্তা থেকে শুধু একনজর দর্শন করে আমরা গাড়িতে উঠে পড়ি। আমাদের গাইড গাড়িতে ইমাম বুখারী (রঃ) এর জীবনী সম্পর্কে বলতে থাকেন ।
বুখারা নগরীতে জন্ম আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে ইসমাইল ইবনে ইবরাহীম ইবনে মুগীরা । মুগীরা সেই ব্যক্তিদের বলা হতো যারা সাহাবীরা জীবিত থাকা অবস্থায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। উনার দাদার পিতা ছিলেন তেমনি একজন ব্যক্তি । ইমাম বুখারী (রাঃ) মাত্র তিন বছর বয়সে দৃষ্টিশক্তি হারান এবং সে সময় উনার পিতাও মারা যান। উনার মা ছিলেন প্রচণ্ড আল্লাহভীরু। তিনি সবসময় পুত্রের দৃষ্টিশক্তি ভালো করে দেওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া এবং কান্নাকাটি করতেন। একদিন তিনি স্বপ্নে দেখেন ইবরহীম (আ:) তাঁর পুত্রের দৃষ্টিশক্তি ভালো হওয়ার সুসংবাদ দেন । ঘুম থেকে জেগেই উনি পুত্রের নিকট ছুটে যান এবং তাকে ঘুম থেকে উঠান। তিনি জেগে দেখেন উনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছেন ।
আল্লাহর এমন বিশেষ রহমত প্রাপ্ত এই শিশু মাত্র ১৬ বছর বয়সে মা ও ভাইসহ হজ্জ করতে যান। সেই সময় মক্কা ছিল আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জ্ঞান অর্জনের প্রাণকেন্দ্র । বিশ্বের সকল ইসলামিক চিন্তাবিদরা সেখানে জমায়েত হতেন! জ্ঞান বিতরণের মেলা বসতো। উনি ছিলেন জ্ঞান পিপাসু। তাই এমন সুযোগ উনি হাত ছাড়া করেননি। মক্কায় থেকে গিয়ে জ্ঞান আহরণ করলেন এবং মাত্র ১৮ বছর বয়সে হাদিসের একটি পূর্ণাঙ্গ বই লিখে ফেলেন যার নাম ‘ইলমাল হিজাল’ ।
বর্তমানে আলেমরা প্রাইমারি রেফারেন্স হিসেবে বইটি ব্যবহার করেন । এরপর ২০ বছর বয়সে তিনি বাগদাদ যান এবং ইমাম হাম্বলের (রহ:) কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। ইমাম হাম্বলে (রহঃ) উনার সম্পর্কে বলেন, খোরসানে জ্ঞানের দিকে আব্দুল্লাহ মোহাম্মদের মতো আমি আর কাউকে দেখিনি । পূর্বে সহি হাদিসের আলাদা কোন বই ছিল না । যইফ, সহি সব একত্রে ছিল। একদিন ওনার শিক্ষক ইসহাক ইবনে রাহোওয়া (রহ:) তার ছাত্রদের শুধু সহি হাদিসের সম্বলিত একটি বই থাকলে ভালো হতো বললে তা ইমাম বুখারীর মনে দাগ কেটে যায় । শুধু তাই নয় যুবক বয়সে তিনি স্বপ্নে দেখেন তিনি আর রাসুল মুহাম্মদ (সাঃ) দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু কিছু মাছি রাসূল মোহাম্মদ (সাঃ) এর মুখের সামনে উড়ে বেড়াচ্ছে আর তিনি তা তাড়িয়ে রাসূল(সাঃ) কে নিরাপত্তা দিচ্ছেন। তিনি স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে পারেন যে তিনি বানোয়াট জাল হাদিসের থেকে রাসূল মোহাম্মদ (সাঃ) এর বিশুদ্ধ হাদিস গুলোকে নিরাপত্তা দেবেন। ফলে তিনি সহি হাদিসের বই লিখবার জন্য মনস্থির করলেন।
১৬ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে মদিনায় তাঁর মুখস্থ থাকা ৬ লক্ষ হাদিস থেকে তিনি বিশুদ্ধতার কষ্টিপাথরে যাচাই করে মাত্র ৭০০০ হাদিস সম্বলিত সহি হাদিসের বই লিখেন। উল্লেখ্য প্রতিটি হাদিস লিখবার পূর্বে উনি নফল নামাজ পড়ে ইস্তেখারা করে নিশ্চিত হয়ে তবেই তা লিপিবদ্ধ করতেন। পরবর্তীতে বুখারায় নিজ জন্মভূমিতে ফিরে যান। কিন্তু সেখানের আমির তাঁকে তাঁর সন্তানদের রাজ দরবারে গিয়ে হাদিস শিক্ষা দিতে বলেন এবং উনি তা হাদিসের জন্য বিরাট অবমাননাকর জানিয়ে প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে আমিরের রোষানলে পড়ে মিথ্যা অপবাদের শিকার হয়ে নিশাপুরে চলে যান। সেখানেও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে সামরকান্দ চলে আসেন এবং দুনিয়ার ফিতনায় বিরক্ত হয়ে শেষ রমযানে ঈদের পূর্ব রাতে আল্লাহর কাছে দোয়া করেন যে তিনি আল্লাহর সন্নিকটে যেতে চান । অতঃপর সেদিন রাতে উটে চড়তে গিয়ে উনি অসুস্থবোধ করেন এবং ৬২ বছর বয়সে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করেন । তার ইতিহাস শুনতে শুনতে আমরা প্রসিদ্ধ বুখারী শরিফ গ্রন্থের রচয়িতা ইমাম বুখারীর (রহ:) বিস্তারিত সম্পর্কে জানি ।এইবার দুপুরের ভোজের জন্য সামারকান্দের একটি উন্নত মানের রেস্টুরেন্টে আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় । সেখানে একটি বিয়ের অনুষ্ঠান চলছিল । আমরা খাবারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি । বিশাল হলঘর । এর উচ্চতা দুই থেকে তিন তলার সমান হবে। হঠাৎ আমাদের সকলের দৃষ্টি বড় বড় সাউন্ড বক্সের গান বাজনার সাথে সাথে নৃত্যের দিকে চলে যায়। বিবাহের অনুষ্ঠান ও নৃত্যে একটা শালিলতা আছে । সকলেই মহিলা ছিলেন।
সবাই গানের তালে তালে তাদের ঐতিহ্যবাহী নৃত্য করে কনে সহ মজা করছেন। আমরাও উপভোগ করছিলাম । যেখানেই আমরা গিয়েছি স্থানীয়রা জানতে চেয়েছেন, ‘আমরা কোন দেশ থেকে এসেছি? ‘ তারা খুবই মিশুক ও বিনয়ী জাতি। পরিচিত হওয়ার পর বুকে হাত রেখে বলেন ‘রাহমা ‘ । এটা তাদের সংস্কৃতি৷ ভাষায় সমস্যা হলেও আকারে ইঙ্গিতে তারা হাসিমুখে আমাদের সাথে কথা বলতো । উজবেকরা সাধারণত উজবেক, তাজকীয় ও রুশ ভাষায় কথা বলেন। লাঞ্চে প্রথমে বিভিন্ন রকম কাঁচা সবজির সালাদ করা হয় । সাথে দেয় বড় বড় চাকার মত গোল নান রুটির মত বন। সালাদের পর্ব শেষ হলে পরিবেশন করে স্যুপ । স্যুপে গোস্তের টুকরা কাবুলি চনা দেওয়া হয়। স্যুপের পর্ব শেষ হলে প্রধান খাবার হিসেবে প্রত্যেককে একটি করে ভেড়ার গোস্তের শিকের কাঠি পরিবেশন করা হয়। সাথে ছোট একটি বাটিতে আঠালো ভাত দেওয়া হয় । সবার শেষে গ্রিন টি পরিবেশন করা হয়। সর্বশেষে ডেজার্ট হিসেবে সুস্বাদু পেস্ট্রি কেক পরিবেশন করে। উজবেকরা ছোট ছোট বাটিতে খাবার শেষে গ্রিন টি পান করে । আমরা তৃপ্তি সহকারে লাঞ্চ সেরে গাড়িতে উঠে পড়ি । (চলবে)
লেখক – পর্যটক, কলামিস্ট, নারী উন্নয়ন কর্মী ও শিক্ষাবিদ, প্রিন্সিপ্যাল, চিটাগং ভিক্টোরী ন্যাশনাল স্কুল- সিভিএনএস