সোমবার, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

পলিথিন ব্যাগ বন্ধ করার উদ্যোগকে স্বাগত জানাই

ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ বিষয়ক উপদেষ্টা একটি পুরনো উদ্যোগ নতুন করে গ্রহণ করতে যাচ্ছে। মেগা শপিং মল থেকে পলিথিন কিংবা পলিথিন জাতীয় ব্যাগ ব্যবহার নিরুৎসাহিত করে তার বিকল্প চালু করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

পলিথিনের সংকট যখন দেশব্যাপী মহামারীর আকার ধারণ করেছে, তখন এর উৎপাদন, বিপণন এবং ব্যক্তি ও পরিবার কেন্দ্রিক ব্যবহার বন্ধ না করলে সীমিত ভূমির বাংলাদেশ খাল, নদী, বিল, ঝিল, হাওর- বাওড়ের বাংলাদেশে পরিবেশের মহামারী ঠেকানো যাবে না।

পুরনো উদ্যোগ নতুন করে গ্রহণের কথার অর্থ হলো ২০০২ সালে তখনকার রাজনৈতিক সরকার পলিথিন ব্যাগের উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করে আইন জারি করে। পরবর্তী সময়ে এর ধারাবাহিকতা সুরক্ষিত না হওয়ায়, সরকার ও প্রশাসনের চরম নির্লিপ্ততায় মানুষ হতাশ হয়েছে। হে উদ্যোগের কার্যকারিতা আর থাকেনি।

একই সাথে জন সচেতনতার উদ্যোগের অভাবে ভোক্তা, উৎপাদনকারী কিংবা বিপণনকারীদের নির্লিপ্ততার কারণে জারি করা আইনটি মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। মানুষ হতাশ হয় আমরা ক্রমান্বয়ে পরিবেশ দূষণের তলানীর দেশের অসম্মান অর্জন করি।

এখন থেকে ২২ বছর আগের এই উদ্যোগ কার্যকরী থাকলে দেশ এতদিনে পলিথিন বিড়ম্বনা মুক্ত হতো, আশা করা যায়।

বর্তমান পরিবেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা পরিবেশ নিয়ে আইন আদালত গরম করে রাখতেন। দেশে-বিদেশে পরিবেশ পদক পেয়ে দেশকে সমৃদ্ধ করেছেন। তার ব্যক্তি পরিচিতি এসেছে, কিন্তু পরিবেশ দূষণ কিংবা দখল কিংবা বিপর্যয় থেমে থাকেনি।

প্রশাসনিক পর্যায়ে না থাকায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবেশ নিয়ে হয়তো তার অতৃপ্তি বা আশাহতে বেদনা থেকে গেছে।
গৃহীত উদ্যোগটি হতে পারে সেই আশাহতের অপূর্ণ কাজটি সম্পূর্ণ করার প্রাথমিক উদ্যোগ। আমরা আশাবাদী।

আমরা আইন তৈরি করি আইনের প্রয়োজনে। নির্লিপ্ত থাকি, বিধি প্রণয়ন করি, বিধির পিছনে উদ্যোগ ও উদ্যমকে নির্লিপ্ত রাখি। সততই যা বলি তা করি না। যা করি তাও সবার সাথে বলি না। কথা যা বলি তা, কাজে পরিণত করি না। এভাবেই আমাদের দৈনন্দিন চলা, বলা, কর্মকাণ্ড, দিনাতিপাত।

এই দেশে দিনে প্রায় বিভিন্ন আকার আকৃতির দেড় কোটি পিস পলিথিনের ব্যাগ উৎপন্ন হয়। এর জন্য দেশে এখনো বিদ্যমান প্রায় তিন হাজার ফ্যাক্টরি।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে সহজলভ্য এই পণ্যটির ব্যবহার বহুগুনে বেড়ে গেছে।

সহজলভ্য হওয়ার কারণে, সহজে বহন করার সুবিধার কারণে, ক্রেতা না চাইতেই পেয়ে যাওয়ার কারণে আমরা পলিথিন ব্যাগের সাথে সংসার করছি প্রায় সত্তর বছর। এটি হিংস্র প্রাণী কিংবা বিষাক্তর সাপের সাথে বসবাস।

আমাদের নদী, নালা, খাল, বিলে আমাদের ব্যবহার করা পলিথিনের শেষ আশ্রয় হয়েছে। আমাদের ভূমির উর্বরতা কমেছে, উৎকর্ষতা কমেছে, উৎপাদনশীলতা কমেছে, সুস্থতা বিলীন হয়েছে। দিনে দিনে পরিবেশ সংকট ঘনীভূত হয়েছে।

আমরা নিরব নির্লিপ্ত থেকেছি। আমাদের শহরে, নগরে, বন্দরে, খাল-নালার জলাবদ্ধতায়, নাব্যহীনতায় পলিথিন আগ্রাসন ছড়াচ্ছে। আমরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। পরিবেশগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি, বিড়ম্বনায় পড়েছি, কিন্তু সচেতন হইনি।

আমাদের আবাসিক এলাকার চারপাশে, স্কুল- কলেজ- মাদ্রাসার আশেপাশে ডাস্টবিন কিংবা ময়লার ভাগাড়ে, রাস্তাঘাটে পলিথিনের প্রাদুর্ভাব দৈনন্দিন জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে।

আমরা পলিথিনের বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পাওয়ার আকাঙ্খা লালন করি কিন্তু প্রশাসনিক কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের অভাবে তার কার্যকারিতা কিংবা অংশগ্রহণমূলক প্রচেষ্টা ধারাবাহিকভাবে গ্রহণ করিনি ।

পলিথিন কিংবা পলিথিন জাতীয় সামগ্রী বর্তমানে বিশ্বের জন্য একটি মহা সংকট। নদী- নালা-খাল- বিল সাগর- মহাসাগর পলিথিনের দূষণে বিপর্যস্ত। মাইক্রো প্লাস্টিক কিংবা পলিথিনের বিড়ম্বনা এখন জীবজগতের ব্যস্ততান্ত্রিকতার মহাবিপদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

বিপর্যয়ের এরকম প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ধাপে ধাপে পলিথিনকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। উদ্যোগটি তখনই নিরঙ্কুশ প্রশংসিত হবে, যখন উদ্যোগের সাথে প্রশাসনিক প্রক্রিয়া, বিধি-বিধান, জনগণের সচেতনতা, জনগণের উদ্যম- উৎসাহ এবং আন্তরিকতা যুক্ত হবে ও বৃদ্ধি পাবে।

একই সাথে পলিথিন উৎপাদনে সম্পৃক্ত শ্রমিক শ্রেণীর মানুষগুলোর জন্য বিকল্প আয়ের উৎস নিশ্চিত করতে হবে। পলিথিনের বিকল্প হিসেবে সারা দুনিয়ার স্বীকৃত পাটের মাতৃভূমি বাংলাদেশ। পাট বিরহের আনলে জ্বলে, অবহেলা ও বিষণ্নতায় তিল তিল করে ক্ষয়ে ক্ষয়ে বিলোপ্তি র বিহ্বলতায় কাতরাচ্ছে, আহাজারি করছে।

সোনালী আঁশের দেশের মানুষ পাটের বদলে পলিথিনকে গ্রহণ করেছিল প্রশাসনিক অদূরদর্শিতায়, পরিবেশ-পরিবেশগত অজ্ঞতায়, আবেগ নিয়ে, উচ্ছ্বাস দিয়ে, টেকসই উন্নয়নের মিথ্যা অহংকার নিয়ে এবং বৈশ্বিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে। বাংলাদেশ সহ-সমগ্র বিশ্বের মানুষের সেই মোহ কেটে গেছে।

পাটের সামগ্রী আধুনিকায়ন, বহুমাত্রিকতা
বহুমুখীনতা এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাথে পাট সামগ্রী সমন্বয়হীনতা, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র আমাদের সমসাময়িক বিশ্বে মূর্খদের কাতারে নিয়ে গেছে।

পাটের ব্যাগ থলে, বস্তা, বিভিন্ন প্রকার পরিবহন সামগ্রী এই বাংলাদেশেই উৎপন্ন হতো। আমরা গত শতকের ষাটের দশকে, পঞ্চাশের দশকে তা ব্যবহার করতাম। আজ তা ইতিহাসের ইতিহাস হয়ে গেছে।

আমাদের অদূরদর্শিতায়, অজ্ঞতায়, মূর্খতায়, নির্লিপ্ততায়, পরশ্রীকাতরতায়, ভিন্ন দেশি সামগ্রী গ্রহণের মানসিকতায় পাটকে আমরা মুমূর্ষ অবস্থায় দিয়ে গেছি। পলিথিনের সামগ্রী বিশেষ করে ব্যাগ, থলে নিষিদ্ধের পাশাপাশি পাটের ব্যাগ, চটের ব্যাগ- থলের বহু মাত্রিক উৎপাদন এবং ব্যবহারে জনগণকে আকৃষ্ট করা খুব কঠিন কাজ হবে বলে আমরা মনে করি না।

তারুণ্যের চেতনায় পাটের প্রয়োজনীয়তাকে, পরিবেশ সম্মত অবয়বকে এবং গুরুত্বকে তুলে ধরে সতের কোটি মানুষের দেশে পাটকে আবারো পুনর্জন্ম দেয়া যায়।

বর্তমান পরিবেশ উপদেষ্টা এই উদ্যোগের ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে এর পিছনে প্রশাসনিক উদ্যোগ ও আইনকে বিস্তৃত ও প্রয়োগ রেখে জনগণকে সচেতন করার মাধ্যম দিয়ে পরিবেশকে সুস্থ রাখার পবিত্র দায়িত্বটি পালন করতে পারে।

আমরা আশাবাদী হতে চাই। আমরা অতীতের মতো কথার ফুলঝুরি, প্রতিশ্রুতির হুড়োহুড়ি, মিথ্যা আস্ফালন- এসব শুনতে শুনতে বিভ্রান্ত হয়ে যাই।

তাই আশা করব, বিভ্রান্তির ছিন্ন স্বপ্ন, ছিন্ন ভিন্ন আকাঙ্ক্ষা আমাদেরকে আর আহত করবে না, আক্রান্ত করবে না। বিভ্রান্ত করবে না।

ধন্যবাদ উদ্যোগ গ্রহণকারীদের।

লেখক বীর মুক্তিযোদ্ধা জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক, পরিবেশ ও রসায়নবিদ

সর্বশেষ

এই বিভাগের আরও খবর