২৫ অক্টোবর’ ২৩ মঙ্গলবার, একদম নিরিবিলি পরিবেশ৷ সকালে হালকা হিমেল বাতাস, নরম রোদ এমন আবহাওয়া মনকে প্রফুল্ল করে দেয়৷ আমাদের গাইড চমৎকারভাবে সব বর্ণনা দিতে দিতে আমাদেরকে এগিয়ে নিয়ে চলেন ইসমাইল সামানীর মাজারে। মূল মাজারের আগে একটি পার্ক। সেখানে আনারের জুস, ভূট্টো, গরম গরম চা- কফি এবং আইসক্রিম এর দোকান রয়েছে৷ সবাই আনারের জুস পান করার জন্য দোকানে ভীড় জমায়। আমাদের সামনে দোকানী তা’ তৈরী করে গ্লাস ভরে দেয়৷ আমরা সবাই তৃপ্তি সহকারে পান করে এগিয়ে যেতে থাকি। উল্লেখ্য আনার উজবেকের জাতীয় ফল।সেখানে সবজায়গাতে আনারের জুস পাওয়া যায়। আমাদের কেউ কেউ পার্কে বিভিন্ন রাইডগুলো উপভোগ করতে চলে যায়৷ আমরা মূল মাজারের দিকে এগিয়ে যাই৷ গাইড নীলুফার এর বৃত্তান্ত ও ইতিহাস বলতে থাকেন৷ সামানিদ মাজার বুখারার উত্তর-পশ্চিম দিকে অবস্থিত৷ ৮১৯ থেকে ৯৯৯ তে সবচেয়ে ক্ষমতাধর শাসক সামানিদদের জন্য সমাধিস্থল হিসেবে ১০ ম শতাব্দীতে এটি নির্মিত হয়৷ এটি মধ্য এশিয়ার সবচেয়ে পুরানো ভবন এবং স্থাপত্য শৈলী সৌধ এবং বুখারার হাজার বছরের পুরনো ভাস্কর্যস্তম্ভগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীনা সামানিদরা আব্বাসীয়া খলিফার শাসকের অধীনে থেকে একটি স্বতন্ত্র স্থানীয় স্বাধীন রাজত্ব গড়ে তোলেন এবং আফগানিস্তান, ইরান উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান ও কাজাখাস্তান শাসন করেন৷ এটি সামানিদদের একমাত্র স্থপতি যা এখনো বিরাজমান৷ এটি ইসমাইল সামানীর পিতার মৃত্যুর পর তার পিতা সামারকান্দের গভর্নর আহমদ ইবনে আসাদের জন্য নির্মিত হয়৷ এটি সামানাদ পরিবারের জন্য পারিবারিক সমাধিস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হয়৷ সামানিদ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ইসমাইল সামানিদ প্রথমে তার বাবার জন্য এটি নির্মান করেন৷ এখানে ইসমাইল সামানিদ এবং তার নাতি হাসরকেও সমাধিস্থ করা হয়৷ সামানিদরা পারসিয়ান সুন্নী মুসলিম ছিল যাদের উৎপত্তি ইরানিয়ান দেহকালের ছিলো৷ তারা শিল্প, সাহিত্যে উন্নতি সাধনে বিশেষ ভূমিকা রাখে৷ মাজারটি চারকোণা৷ এতে এমনভাবে পাথরের উপর কারুকাজ করা যে সূর্যের আলোর সাথে এর দেয়ালে এবং মেঝেতে চকচক করতে থাকে ৷ মাজারের গায়ে নানা রকমের চিহ্ন বা নিদর্শন অঙ্কিত আছে। এর কিউবিক আকৃতি মক্কার পবিত্র কাবা ঘরের আদলে তৈরি এবং পবিত্র কাবাকে মনে করিয়ে দেয় । শুধু তাই নয় এটি পৃথিবীকে এবং উপরের গম্বুজটি আকাশকে নির্দেশ করে । এর প্রবেশ খিলানটি ইটের তৈরি গোলাকৃতির চাকতির যা সূর্য ও গ্রহ গুলোর নিদর্শন প্রকাশ করে । এছাড়া এর ইটের গায়ে অনেকটা জালের মতো বোনা ঝুড়ির আকৃতির। ফলে সূর্যের আলোর কমবেশিতে ভবনটির রং পরিবর্তিত হয় । ভবনটির ভিতরেই রাজকীয় মাজার রয়েছে। কথিত আছে ইসমাইল সামানি, এই কিংবদন্তি যিনি অসাধারণ কৌশলী এবং সাহসী সেনাপতি ছিলেন, তার মৃত্যুর পরও তিনি বুখারার শাসক ছিলেন।কারণ মাজারের এক পাশে ছোট জানালার মত খোলা জায়গায় কোন প্রশ্ন চিরকুট রেখে গেলে পরদিনই তার উত্তর পাওয়া যেত । চেঙ্গিস খানের ধ্বংসযজ্ঞের সময় এই মাজার রক্ষার জন্য সেখানকার অধিবাসীরা তা বালি দিয়ে আবৃত করে দেয়।
(এটি সামানিড যুগের একমাত্র টিকে থাকা স্মৃতিস্তম্ভ, তবে আমেরিকান শিল্প ইতিহাসবিদ আর্থার আপহাম পোপ এটিকে ” পারস্যের অন্যতম সেরা ” বলে অভিহিত করেছেন। নিখুঁতভাবে প্রতিসাম্য, আকারে কম্প্যাক্ট, তবুও গঠনে স্মারক, সমাধিটি শুধুমাত্র বহু-সাংস্কৃতিক ভবন এবং সজ্জাসংক্রান্ত ঐতিহ্য যেমন সোগডিয়ান , সাসানীয় , পার্সিয়ান এবং এমনকি শাস্ত্রীয় এবং বাইজেন্টাইন স্থাপত্যকেও একত্রিত করেনি , কিন্তু ইসলামিক স্থাপত্যের জন্য প্রথাগত বৈশিষ্ট্যগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করেছে – বৃত্তাকার গম্বুজ এবং ছোট গম্বুজ, নির্দেশিত খিলান, বিস্তৃত পোর্টাল, কলাম এবং ইটের গাঁথুনিতে জটিল জ্যামিতিক নকশা । প্রতিটি কোণে, সমাধির নির্মাতারা স্কুইঞ্চ নিযুক্ত করেছিলেন , একটি বর্গের উপর বৃত্তাকার-প্ল্যান গম্বুজটিকে সমর্থন করার সমস্যার একটি স্থাপত্য সমাধান। ভবনটি নির্মাণের কয়েক শতাব্দী পরে পলিতে চাপা পড়েছিল এবং 20 শতকে ইউএসএসআর- এর অধীনে পরিচালিত প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে এটি প্রকাশিত হয়েছিল ।)
১৯৩৪ সালে এটি পুনরুদ্ধার করে পুনঃস্থাপন করা হয়। মাজারটির আলংকারিক ঐতিহ্য বহু সংস্কৃতির ধারক। এটি সোগদিয়ান, সামানিয়ান, পারসিয়ান এবং বাইজেনটাইন স্থাপত্যশৈলীর ঐতিহ্য ধারণ করেন। আমরা সেখানকার মনোরম পরিবেশে কিছু সময় কাটিয়ে পরবর্তী গন্তব্যের দিকে ছুটে চলি । এইবার সেখানকার একটি পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী মসজিদে যোহরের সালাত আদায় করতে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর দুপুরের খাবার । মসজিদটির নাম হল ‘বোলো খাউজ’ মসজিদ। এটি আমিরের দুর্গ – আর্ক এর বিপরীতে অবস্থিত । মসজিদ কমপ্লেক্সটিতে একটি জলাধার, একটি মসজিদ ও মিনারেট রয়েছে। এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও প্রাচীন অংশ হচ্ছে এর পুকুর (খাউজ) যার কারণে এর নাম রাখা হয় বোলো খাউজ অর্থাৎ ‘শিশুদের জলাধার’। এটি বুখারার অসংখ্য প্রাচীন পুকুরগুলোর একটি যা আজও বিরাজ করছে। তৎকালীন বুখারায় পানি সংকটের কারণে এটি সেখানকার অধিবাসীদের জন্য পানির উৎস ছিল । বদ্ধ জলাশয় হবার কারণে তা সে সময় অধিবাসীদের পানিবাহিত রোগেরও কারন ছিল। ১৭১২ সালে তখনকার আমিরের স্ত্রীর নির্দেশে এটি নির্মিত হয়। আবার অনেকে বলেন তখনকার আমির শেখ মুরাদের (১৭৮৫ থেকে ১৮০০) নির্দেশে এটি সাধারণ জনগণের জন্য নির্মাণ করেন কারণ তিনি সাধারণ জনগণের সান্নিধ্য পছন্দ করতেন। এতে উজবেকীয় ঐতিহ্যবাহী বারান্দা রয়েছে যা কাঠের সিলিংয়ের এবং ঐতিহ্যবাহী কাজ করা কাঠের পিলারের তৈরি । এর পিলারগুলো নকশাকাটা কাঠ দিয়ে এবং ফুলও জিওমেট্রিক ডিজাইন দিয়ে অলংকৃত করা হয়েছে। মসজিদের সামনে একটি ছোট মিনারেট ১৯১৭ সালে বুখারার একজন প্রসিদ্ধ ব্যক্তি শিরিন মুরাদোভ নির্মাণ করেন। আমরা সেখানে পৌঁছালে নামাজের ইকামত চলতে থাকে । আমরা দ্রুত অজু করে নামাজের জামাতে দাঁড়াই । মসজিদের ভিতরে মহিলাদের জন্য পৃথক অজুখানা ও নামাজের স্থান রয়েছে।যা আমাদের দেশে অনেকটা অকল্পনীয় ব্যাপার। মোটা সুন্দর কার্পেটে মসজিদের ভিতরে এবং বাইরের বারান্দা আবৃত। মসজিদটি শীতকাল এবং গ্রীষ্মকালের মুসল্লিদের নামাজ আদায়ের সুবিধার জন্য বিশেষভাবে নির্মিত। মসজিদের মধ্যভাগ ভারী ইট দিয়ে তৈরি যা ঘরকে গরম রাখে যাতে শীতে বাতাস প্রবেশ করতে না পারে । আর এর সংলগ্ন ২০টি কাঠের পিলারের উপর বারান্দা গ্রীষ্মকালে সুন্দর বাতাসে মুসল্লীদের আরামে নামাজ আদায় করার সুবিধার জন্য তৈরী করা হয়। এর সামনেই পুকুর অবস্থিত যেখান থেকে অবারিত ঠান্ডা বাতাস প্রবাহিত হয় । এর চমৎকার ইন্টেরিয়র ডিজাইন সবাইকে আকৃষ্ট করে। বিদেশী পর্যটকরাও মসজিদের আদব রক্ষা করে শালীন পোশাকে সেখানে ঘুরতে আসে। মসজিদটি সত্যিই একটি শান্তিময় স্থান । পুকুরের কাছে অবস্থিত হওয়ায় ঠান্ডা বাতাস এবং এর কাঠের স্তম্ভগুলো এর সম্মুখভাগে একে অনবদ্য সৌন্দর্য দান করেছে। আমরা সবাই অপেক্ষমান বাস- এ উঠি। সেখানকার স্থানীয় একটি রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করানো হবে। তিন তলার এই রেস্টুরেন্টে মহিলাদেরকে দোতালায় ও পুরুষদেরকে তিনতলায় বসানো হয়। বেশ সুন্দর ও আধুনিক রেস্টুরেন্ট । আমাদের গাইড খাবার মেনু থেকে আমাদের পছন্দ জেনে তাদেরকে খাবার অর্ডার দেন। আমরা সব মহিলারা খুব মজা করে গল্প করতে করতে তাদের প্রচলিত লাঞ্চ উপভোগ করি ।
লেখক – পর্যটক, কলামিস্ট, নারী উন্নয়ন কর্মী ও শিক্ষাবিদ, প্রিন্সিপ্যাল, চিটাগং ভিক্টোরী ন্যাশনাল স্কুল- সিভিএনএস ।