দেশের জাতীয় ও দ্বিতীয় বেসামরিক পুরষ্কার একুশে পদকে ভুষিত হলেন চট্টগ্রামের পাঁচ কৃতী সন্তান। তারা হলেন, শিক্ষায় বিশেষ অবদানের জন্য অধ্যাপক ড. জিনবোধি ভিক্ষু,ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য মিনার মনসুর,শিল্পকলায় সংগীত ক্যাটাগরিতে বীর মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণী ঘোষ,মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রামান্যচিত্র নির্মাণ ও আর্কাইভিংয়ে কাওসার চৌধুরী, ও সমাজ সেবায় রফিক আহমেদ।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দেশের ২১ নাগরিককে একুশে পদক ২০২৪ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে ৫ জন চট্টগ্রামের স্বন্তান। যারা দেশের কাজে নানা ভাবে অবদান রেখেছেন
ড. জিনবোধি ভিক্ষু
শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় স্বীকৃতি স্বরূপ একুশে পদক পাচ্ছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) পালি বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনবোধি ভিক্ষু। শিক্ষা বিস্তারে বিশেষ অবদানের জন্য অধ্যাপক ড. জিন বোধি ভিক্ষু কে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক সম্মাননা ২০২৩ এ ভূষিত করা হয়। একুশে পদকে মনোনীত হয়ে জিনবোধি ভিক্ষু বলেন, তুমি শুধু লেখাপড়া করবে না, পিছিয়ে পড়া জাতিকে শিক্ষায় সমুন্নত করার জন্য ভূমিকা রাখবে’। আমি মায়ের কথাকে প্রধান্য দিয়ে জাতির জন্য কাজ করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল ও অতীশ দীপঙ্কর হল করে দিয়েছি। এছাড়া অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করার জন্য কাজ করছি। একুশে পদকে আমাকে মনোনীত করায় আমি আনন্দিত। এজন্য আমি ধন্যবাদ জানাই প্রধানমন্ত্রীকে এবং আমার কলেজ জীবনের শিক্ষক একুশে পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হককে। আমি বিশ্বাস করি আমাদের শিক্ষকরা যদি সঠিকভাবে কাজ করে তাহলে তাঁরা এমন সম্মানে ভূষিত হবেন।’
মিনার মনসুর
মিনার মনসুর ১৯৬০ সালের ২০ জুলাই চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার বরলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক (১৯৮৩) ও স্নাতকোত্তর (১৯৮৪) পাশ করেন। উভয় পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্তির জন্যে শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহ স্মৃতি পুরস্কার পান। চট্টগ্রামের এই কৃতী সন্তান একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক। বর্তমানে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মিনার মনসুর মূলত একজন কবি। তবে গদ্যেও দ্যুতিময় তার কলম। তার কবিতায় উঠে এসেছে বাংলার মানুষের জীবন। ১৯৭৫-৮৫ সালে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে বৈরী শক্তির বিরুদ্ধে অবিরাম লড়াই করা যাওয়া একজন সৈনিক তিনি । বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত প্রথম সংকলন-গ্রন্থ ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’ (১৯৭৯; বাংলা একাডেমি, ২০২০)।
কল্যাণী ঘোষ
স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের কণ্ঠসৈনিক শিল্পী কল্যাণী ঘোষ। খ্যাতনামা সঙ্গীত এই শিল্পীর জন্ম ১৯৪৬ সালে চট্টগ্রামের রাউজানে। সংগীতের অমিয় ধারায় নিজেকে সিক্ত করার পাশাপাশি গড়ে তুলেছিলেন কিছু সংগঠনও। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার জাদুকরী কণ্ঠ দিয়ে উজ্জীবিত করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের, সংগঠিত করেছিলেন লাখ লাখ শরণার্থীসহ সাধারণ মানুষকে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর বোরখা পরে মুখে কালি মেখে দুই বছরের সন্তানকে কোলে করে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে রামগড় সীমান্ত পার হয়ে চলে গিয়েছিলেন প্রতিবেশী দেশ ভারতে। সেখানে যোগ দিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। গানের মাধ্যমে সেখানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি ও দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান ছিল কৃতী এই সঙ্গীতশিল্পীর।
কাওসার চৌধুরী
চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক কাওসার চৌধুরী মহেশখালী মাতারবাড়ীর কৃতি সন্তান। ১৯৮১ সাল থেকে দীর্ঘ ৪১ বছরে অসংখ্য প্রামাণ্যচিত্র, তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন তিনি। বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বিভিন্ন স্যাটেলাইট চ্যানেলে নাটক, সিরিয়াল, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানসহ তিন শতাধিক অনুষ্ঠান নির্মাণ করেছেন। নব্বইয়ের দশক থেকে তিনি মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বিষয়ে মনোযোগী হন।মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বেশ কিছু প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল হয়ে আছে সেসব। তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় বধ্যভূমি নিয়ে অসংখ্য প্রামাণ্যচিত্র, তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন এবং দুর্লভ প্রামাণ্যচিত্র, তথ্যচিত্রগুলো একুশে টেলিভিশনসহ বিভিন্ন টেলিভিশনে প্রচারিত হয়।
রফিক আহমেদ
সমাজ সেবায় এক অনন্য ব্যাক্তিত্ব চট্টগ্রামের রফিক আহমেদ। পিছিয়ে পড়া পরিবারের নারীদের স্বাস্থ্য এবং তাদের পরিবারের কল্যাণ, স্বাস্থ্যসেবার মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য কমানো, শিশুদের লেখাপড়ার ব্যবস্থায় উদ্বুদ্ধ করতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মমতা ক্লিনিক এর। বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ সালে পরিবার পরিকল্পনা এবং মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবায় পুরো দেশের সেরা বেসরকারি ‘ক্লিনিক’ হয়। আগেও তারা ১১ বার ১৯৯১, ৯৯, ২০০০, ০১, ০২, ০৭, ১০, ১২, ১৩, ১৬, ১৭ এবং ১৮ সালে সেরা ক্লিনিকের পুরস্কার পেয়েছে। ৩৬ বছরে ৭২ হাজার মায়ের সিজারিয়ান (অস্ত্রোপচার) ও স্বাভাবিক সন্তানের জন্মের ব্যবস্থা করেছেন। খরচ নিয়েছেন দুই থেকে সাত হাজার টাকা। যারা এ টাকাও জোগাড় করতে পারেননি, তাদেরও ফেরায়নি ‘মমতা’। সেবা দিয়েছে সবচেয়ে ভালো। গড়ে তুলেছে পূর্ণাঙ্গ, আধুনিক দুটি মাতৃ হাসপাতাল। বিত্তহীন শ্রমজীবী ও অবহেলিত মায়েদের দিচ্ছে সব ধরনের স্বাস্থ্যসেবা। ফলে মমতা হয়েছে বিভাগ ও জেলাগুলোর মধ্যেও সেরা হাসপাতাল তিনি পেয়েছেন একুশে পদক।
এছাড়াও যারা একুশে পদক পেলেন , ভাষা আন্দোলনে অবদান রাখায় মৌ. আশরাফুদ্দীন আহমদ (মরণোত্তর) ও বীর মুক্তিযোদ্ধা হাতেম আলী মিয়াকে (মরণোত্তর) একুশে পদক দেওয়া হচ্ছে।শিল্পকলায় সংগীত ক্যাটাগরিতে একুশে পদক পাচ্ছেন জালাল উদ্দীন খাঁ (মরণোত্তর), বিদিত লাল দাস (মরণোত্তর), এন্ড্রু কিশোর (মরণোত্তর) ও শুভ্র দেব।নৃত্যকলায় একুশে পদক পাচ্ছেন শিবলী মোহাম্মদ, অভিনয়ে ডলি জহুর, এম এ আলমগীর, আবৃত্তিতে খান মো. মুস্তাফা ওয়ালীদ (শিমুল মুস্তাফা) ও রূপা চক্রবর্তী।চিত্রকলায় শাহজাহান আহমেদ বিকাশ ,সমাজসেবায় মো. জিয়াউল হক ভাষা ও সাহিত্যে মুহাম্মদ সামাদ, লুৎফর রহমান রিটন ও রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (মরণোত্তর)।