২ বছর পর সংস্কার কাজ শেষে সর্বসাধারণের জন্য আবারো খুলে দেয়া হয়েছে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশে অবস্থিত ‘জাতিসংঘ পার্ক’। তবে পার্কটি এখন থেকে ‘জুলাই স্মৃতি উদ্যান’ নামেই পরিচিত হবে। আজ শুক্রবার দুপুরে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান এটি উদ্বোধন করেন।
এসময় সিটি মেয়র শাহাদাত হোসেন, জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম এবং প্রকল্প বাস্তবায়নকারী গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। উদ্বোধনের সময় উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, ‘জুলাই-আগস্টের শহীদ ওয়াসিম আকরামের স্মরণে তার নামে চট্টগ্রামে একটা উড়াল সেতু এবং এখানে জুলাই স্মৃতি উদ্যান, শহীদদের স্মরণে করা হলো’। তিন আরো বলেন, ‘যারা অন্যায় অবিচার ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গত ১৫ বছর সংগ্রাম করেছে তাদেরকেও স্মরণ করছি। কখনোই যেন ফ্যাসিবাদ ফেরত আসতে না পারে। আগামী প্রজন্ম যেন জুলাই আগস্টের শহীদদের ত্যাগের কথা মনে রাখতে পারে সেজন্যই এই নামকরণ।’
এদিকে উদ্বোধনের পর শুরুতে জনবল সংকটের কারণে পার্কটি প্রতিদিন অল্প সময়ের জন্য খোলা থাকবে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে পিডব্লিউডি, চট্টগ্রাম (বিভাগ-১) এর নির্বাহী প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম খান বলেন, ‘শুক্রবার বিকেলে আমরা এটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেব। প্রাথমিকভাবে পার্কটি প্রতিদিন বিকাল তিনটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টা খোলা থাকবে।’
পার্ক স্বল্প সময়ের জন্য কেন খোলা থাকবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কর্মী সংকটের কারণে পার্কটি প্রতিদিন বেশি সময় খোলা রাখা যাবে না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা ২১ জন কর্মী নিয়ে পার্কের জন্য জনবল স্থাপনের জন্য একটি প্রস্তাবনা তৈরি করেছি। আমরা জনবল নিয়োগের অনুমোদনের জন্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছি।’ তিনি আরও জানান, মন্ত্রণালয় এখনও জনবলের অনুমোদন দেয়নি। ‘তাই, প্রাথমিকভাবে আমরা চট্টগ্রামের গণপূর্ত বিভাগ পরিচালিত অন্যান্য পার্ক থেকে জনবল নিয়ে পার্কটি চালু করছি’, যোগ করেন তিনি।
পিডব্লিউডির এই প্রকৌশলী আরো বলেন, ‘আমরা এই পার্ক দেখাশোনার জন্য প্রাথমিকভাবে চার কর্মীকে দায়িত্ব দিয়েছি’, তিনি বলেন, ‘এই পার্কের দেখাশোনার জন্য অন্যান্য পার্ক থেকে কিছু কর্মী আনা হয়েছে, এতে করে সেই পার্কগুলো পরিচালনা করতেও বেশ সমস্যায় পড়তে হবে।’
উল্লেখ্য, ৬৯ একর আয়তনের পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকাটি গণপূর্ত অধিদপ্তরের দায়িত্বে। ১৯৫৪ সালে আবাসিক এলাকাটির জন্য জমি বরাদ্দ দেয় সংস্থাটি। এর মাঝে ২ দশমিক ১৭ একর আয়তনের ওই উদ্যানের নাম শুরুতে ছিল ‘পাঁচলাইশ পার্ক’। ১৯৮৮ সালে মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী মেয়র থাকাকালে গণপূর্ত অধিদপ্তর সংস্কার ও ব্যবস্থাপনার জন্য পার্কের দায়িত্ব দেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের হাতে।
২০০২ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এক প্রস্তাবে সে সময়ের মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী এই পার্কের নাম দেন ‘জাতিসংঘ পার্ক’। সেই থেকে পার্কটি এই নামেই পরিচিত। পরের মেয়র মনজুর আলমের মেয়াদে ২০১২ সালে সিটি করপোরেশন পার্কে দুটি সুইমিং পুল ও একটি জিমনেশিয়াম নির্মাণ শুরু করলে সেখানে জনসাধারণের চলাচল বন্ধ থাকে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে সুইমিং পুল নির্মাণ শেষ হলেও সেটি খুব বেশিদিন ব্যবহার হয়নি।
এর পর মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ২০১৬ সালে বেসরকারি এক কোম্পানির কাছে পার্কটি ইজারা দিতে চাইলে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। তারপর সিটি করপোরেশন ও গণপূর্তের দ্বন্দ্বে আরো কয়েক বছর গড়িয়ে যায়। তখন থেকে পার্কটি অব্যবহৃত ছিল।
এভাবে অব্যবহৃত পড়ে থাকায় পার্কে জমেছিল আবর্জনা। মাঠ জুড়ে ছিল বড় বড় গর্ত। এক পর্যায়ে পার্কটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। সবশেষ ২০২২ সালে ১২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয়ে পার্কটির আধুনিকায়নে ‘জাতিসংঘ সবুজ উদ্যান’ প্রকল্পটি হাতে নেয় গণপূর্ত অধিদপ্তর। ওই প্রকল্পের আওতায় ভূমি উন্নয়ন শেষে মাঠের মাঝখানে তৈরি করা হয় একটি দৃষ্টিনন্দন ফোয়ারা। পার্কের চারপাশ ঘিরে তৈরি করা হয় ২৯৪০ বর্গফুট হাঁটার পথ (ওয়াকওয়ে)।
স্থাপন করা হয়েছে বসার জন্য ৪৪টি বেঞ্চ, দুটি প্রবেশপথ, শিশু-কিশোরদের খেলার সরঞ্জাম, ব্যয়ামের জন্য হরাইজন্টাল বার ও মেটাল পেরগোলা, ড্রেনেজ সিস্টেম, ডাস্টবিন, টয়লেট ব্লক, আলোকায়নের জন্য কম্বাইন্ড লাইট ও স্ট্রিট লাইট, সিসিটিভি ক্যামরা, সোলার পাওয়ার সিস্টেম ও বজ্রনিরোধক।
এছাড়া পার্ক জুড়ে নতুন করে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ও ঘাস লাগানো হয়েছে। এতে এক সময়ের পরিত্যক্ত হয়ে পড়া পার্কটি আবার যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। দুটি সুইমিংপুল নির্মাণ, পার্ক ঘিরে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে দ্বন্দ্ব, সুইমিংপুল দুটি ভাঙা, নতুন প্রকল্প গ্রহণ- সব মিলে পেরিয়ে গেছে এক যুগ। অবশেষে আবার সবার জন্য খুলল বন্দরনগরী চট্টগ্রামের এই উদ্যানটি।
এদিকে দীর্ঘদিন পর পার্কটি আবার চালু হওয়ায় খুশি স্থানীয় বাসিন্দারা। তারা বলেন, ‘পাঁচলাইশ, কাতালগঞ্জ, চকবাজার, কাপাসগোলা, বাদুরতলা, শুলকবহর, মির্জারপুল, প্রবর্তক, সুগন্ধা ও মুরাদপুর এলাকায় আর কোনো পার্ক নেই, তাই এসব এলাকার লোকজন অবসর বিনোদনের জন্য এই পার্কে আসতেন।’
তারা আরো জানান, ‘প্রায় ছয় বছর ধরে পার্কটি বেহাল অবস্থায় থাকায় আমরা এখানে সময় কাটানো থেকে বঞ্চিত ছিলাম। আমরা খুশি যে সংস্কার কাজ শেষ হওয়ার পর এই পার্কটি উন্মুক্ত হচ্ছে এবং আমরা আবারো এই সুযোগটি ফিরে পাব।’ তারা পার্কটি সকাল-সন্ধ্যা খোলা রাখার জন্য প্রয়োজনীয় জনবল মঞ্জুর করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
এনইউ/জই